ঢাকা টাইমস্ ডেস্ক ॥ একই দিন হূমায়ুন আহমেদের মরদেহের সঙ্গেই ফেরার কথা থাকলেও ২৬ জুলাই মেয়ে বিপাশাকে নিয়ে দেশে ফিরেছেন গুলতেকিন।
‘গুলতেকিনের চোখে তখন জল’
মাকে দেখেই নোভা, শীলা আর নুহাশ হাউমাউ করে কেঁদে ওঠেন। জড়িয়ে ধরেন মাকে। এ সময় গুলতেকিনও চোখের জল ধরে রাখতে পারেননি। তার দু’চোখের কোণে গড়িয়ে পড়ছিল পানি। নন্দিত লেখক হুমায়ূন আহমেদের প্রথম স্ত্রী গুলতেকিন। মেয়ে বিপাশাকে নিয়ে আমেরিকা থেকে গতকালই দেশে ফেরেন তিনি। মা ও বোনকে দেখে দুই বোন নোভা ও শীলা, পুত্র নুহাশ পিতার শোকে কেঁদে ওঠেন। তাদের কষ্ট ও কান্না দেখে গুলতেকিনেরও চোখের জল বেরিয়ে আসে। সন্তানদের কাছে লৌহমানবী হিসেবে পরিচিত গুলতেকিন কিছু সময় পরই নিজেকে সামলে নেন। সন্তানদের সান্ত্বনা দেন। গতকাল সকালে তার বনানীর বাসায় এমন দৃশ্যের অবতারণা হয়।
তাদের ঘনিষ্ঠ একটি সূত্র জানায়, অভিমানী গুলতেকিন অনেক কষ্ট করে নিজেকে আজকের পর্যায়ে দাঁড় করিয়েছেন। সন্তানদের মানুষ করেছেন। তার এতটাই অভিমান ছিল যে- তিনি মেয়েদের বিয়েতে হুমায়ূন আহমেদকে আমন্ত্রণ জানাননি। তিনি সব সময়ের জন্য হুমায়ূনকে ভুলে থাকার চেষ্টা করেছেন। তার ঘনিষ্ঠ একজন জানান, হুমায়ূনবিহীন একা সংসারের হাল ধরে টেনে নিয়ে যেতে তাকে অনেক কষ্ট করতে হয়েছে। তবে তিনি পথ চলতে নিজের জন্য প্রয়োজন না হলেও সন্তানদের জন্য অনেক ক্ষেত্রে হুমায়ূনের ভাই ড. জাফর ইকবালের সহযোগিতা নিয়েছেন। তার স্ত্রীও অনেক সহযোগিতা করেছেন। সন্তানদের কথা চিন্তা করে তিনি দ্বিতীয়বার বিয়েও করেননি। তিন মেয়েকে বিয়ে দিয়েছেন। মেয়েরা সবাই মেধাবী। তিন মেয়েই পিএইচডি করেছেন। সূত্র জানায়, আত্মঅভিমানী এক নারী গুলতেকিন। যিনি সব সময় চেষ্টা করেছেন নিজের আত্মসম্মান বোধটুকু বাঁচাতে। সেই অনুযায়ী কাজ করেছেন। এমনটাই মন্তব্য তার পরিবারের ঘনিষ্ঠ জনের। গতকাল সকাল ৮টা ৪০ মিনিটে তিনি এমিরেটসের ফ্লাইটে মেয়ে বিপাশাকে নিয়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র থেকে দেশে ফিরে আসেন। বিমানবন্দরে তাকে আনতে যান তার বড় মেয়ে নোভা, বড় মেয়ের জামাই, মেজ মেয়ে শীলা। বিমানবন্দরে যখন নামেন তখন তিনি ভীষণ ক্লান্ত। বিমানবন্দরে নেমে তিনি কোন আবেগঘন দৃশ্যের অবতারণা করেননি। স্বাভাবিকভাবে বের হয়ে গেছেন। বাসায় যাওয়ার পর আবেগঘন পরিবেশ তৈরি হয়। তার সঙ্গে কথা বলার জন্য আগ্রহ প্রকাশ করলে তার পরিবারের তরফ থেকে জানানো হয়, তিনি খুব ক্লান্ত। একটু সময় দিন। তিনি কোন কথা বলবেন কিনা তা এখনও বলা যাচ্ছে না। তবে তার ঘনিষ্ঠ একজন অনুরোধ করে বলেন, তাকে আপনারা সব কিছু থেকে বাইরে রাখুন। এটা আপনাদের কাছে অনুরোধ। তাকে আপনারা টানবেন না।
আমেরিকায় থেকেও হুমায়ূন আহমেদের মৃতদেহও দেখতে যাননি তার প্রথম স্ত্রী গুলতেকিন
আমেরিকায় থেকেও একটিবারের জন্যও চিকিৎসাধীন অবস্থায় হুমায়ূন আহমেদকে দেখতে হাসপাতাল বা তার বাসায় দেখতে যাননি তার সাবেক স্ত্রী গুলতেকিন। এমনকি মৃত্যুর পর হুমায়ূনের মৃত্যুদেহও দেখতে না আসায় লেখকের স্বজন ও বন্ধুরা অবাক হয়েছেন। সদ্য প্রয়াত নন্দিত লেখক ও নির্মাতা হুমায়ূন আহমেদের জীবনের প্রায় অর্ধেক সময়ে তার অস্তিত্বজুড়ে ছিলেন গুলতেকিন। ৩০ বছরের সংসার ছিল হুমায়ূন-গুলতেকিন দম্পতির। এ দীর্ঘ সময়ে একে অন্যের ছিলেন আনন্দ-বেদনার সারথী। ১৯৭৩ সালে তাদের বিয়ে হয়। বিচ্ছেদ ঘটে ২০০৩ সালে। দীর্ঘ এতো বছর যে নারী একজন কালজয়ী লেখকের জীবনের বিশাল সময়জুড়ে সঙ্গে ছিলেন সে নারী একবার মৃত্যুশয্যায়ও খোঁজ নেবেন না, তা স্বয়ং হুমায়ূনও ভাবতে পারেননি! যে দেশে হুমায়ূন আহমেদ চিকিৎসাধীন ছিলেন সে দেশে গুলতেকিনও অবস্থান করছিলেন। বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, নোবেলজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূসসহ অনেকেই দেখতে গিয়েছেন লেখককে। নিউইয়র্কে অসুস্থ লেখককে দেখতে গিয়েছেন পরিচিত-অপরিচিত অনেকেই, কেবল গুলতেকিন ছাড়া। জানা গেছে, আমেরিকায় থেকেও গুলতেকিন হুমায়ূনের মৃত্যুদেহও দেখতে না আসায় লেখকের স্বজন ও বন্ধুরা অবাক হয়েছেন। হুমায়ূন আহমেদের পারিবারিক সূত্রসহ একাধিকসূত্রে জানা গেছে, হুমায়নের মৃত্যুর পর বাংলাদেশ সময় শনিবার দুপুর পর্যন্ত গুলতেকিন কোনো খোঁজ নেননি। হুমায়ূন আহমেদের অনেক লেখায় এসেছে গুলতেকিনের নাম। তার প্রথম দিকের প্রকাশিত বইগুলোর কয়েকটি উৎসর্গ করেছিলেন গুলতেকিনকে। তিনি গুলতেকিন সম্পর্কে বলেছিলেন, ‘জীবনের শ্রেষ্ঠ নারী গুলতেকিন।’ হুমায়ূন তার আত্মজীবনী ‘আপনারে আমি খুঁজিয়া বেড়াই’ বইটিতেও তার লেখক হয়ে ওঠার পেছনে গুলতেকিনের অবদানের কথা উল্লেখ করেছেন। একাত্তরে দেশ স্বাধীনের কিছুদিন পরই হুমায়ূনের প্রেমে পড়েছিলেন প্রিন্সিপাল ইবরাহীম খাঁর নাতনি গুলতেকিন। ১৯৭৩ সালেই হুমায়ূন আহমেদ গুলতেকিনকে বিয়ে করেন। ২০০৩ সালে হুমায়ূন-গুলতেকিনের সংসারের সমাপ্তি হয়। বিয়ে-বিচ্ছেদের পর ছেলে-মেয়েদের নিয়ে অনেকটা অন্তরালে চলে যান গুলতেকিন। একপর্যায়ে তিনি যুক্তরাষ্ট্রে চলে যান। বর্তমানে সেখানেই অবস্থান করছেন। একাধিক সূত্র জানায়, হুমায়ূনের অসুস্থ্তা ও মৃত্যু সংবাদের পরও দেখা করার ব্যাপারে কোনো ধরণের আগ্রহ দেখাননি গুলতেকিন। যোগাযোগ করা হলে কথাসাহিত্যিক হুমায়ূনের ছোট ভাই রম্য ম্যাগাজিন উন্মাদের সম্পাদক আহসান হাবীব বলেন, ‘‘আমার জানা মতে, তিনি (গুলতেকিন) এখনও পর্যন্ত দেখতে আসেননি।’’ তিনি জানান, গুলতেকিন বর্তমানে আমেরিকারই কোনো একটি প্রদেশে অবস্থান করছেন। অভিমানী-জেদি গুলতেকিন হুমায়ূন আহমেদ ও গুলতেকিনের পরিচিত ও একসময়ের কাছের একজন নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, ‘‘বিচ্ছেদের পর গুলতেকিন কাছের অনেককে বলেছেন, হুমায়ূনের মৃত মুখও কখনো দেখতে চাইবেন না এবং হুমায়ূনের কোনো খবরই তাকে আনন্দে উদ্বেলিত কিংবা বেদনাক্রান্ত করবে না।’’ তিনি জানান, এখনও জেদের বশেই আছেন গুলতেকিন। বিচ্ছেদের পর কোনো রকম যোগাযোগই করেননি বলেও তিনি জানান। হুমায়ূন-গুলতেকিনের সংসারে তিন মেয়ে ও দুই ছেলে। তিন মেয়ের নাম বিপাশা আহমেদ, নোভা আহমেদ, শীলা আহমেদ এবং ছেলের নাম নুহাশ আহমেদ। নুহাশের নামেই গাজীপুরে হুমায়ূন আহমেদ গড়ে তোলেন স্বপ্নের নুহাশ পল্লী। গুলতেকিনের নামে রাজধানীর হুমায়ূন ধানমণ্ডির পাঁচতলা একটি বাড়ি লিখে দিয়েছেন বলে জানা গেছে। হুমায়ূনের দ্বিতীয় জীবন এবং শাওন ১৯৯০ সালের মধ্যভাগ থেকে মেয়ে শীলার বান্ধবী এবং তার বেশ কিছু নাটক-চলচ্চিত্রে অভিনয় করা অভিনেত্রী মেহের আফরোজ শাওনের সঙ্গে হুমায়ূন আহমেদের ঘনিষ্ঠতা জন্মে। ২০০৫ সালে বিয়ে হুমায়ূন আহমেদ বিয়ে করেন শাওনকে। হুমায়ূন-শাওনের সংসারে ৩ সন্তান জন্মগ্রহণ করে। প্রথম মেয়ে-সন্তান ভূমিষ্ট হওয়ার পর মারা যায়। বর্তমানে হুমায়ূন-শাওন দম্পতির দুই ছেলে হচ্ছে নিষাদ ও নিনিত। বিয়ের পর হুমায়ূন আহমেদ তার সেন্টমার্টিনের বাড়ি ‘সমুদ্র বিলাস’ লিখে দেন শাওনের নামে। মেয়েরা দেখে গেছেন অসুস্থ বাবাকে। প্রথম স্ত্রীর সঙ্গে বিচ্ছিন্ন হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে তার মেয়েরাও বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েন বাবা হুমায়ূন আহমেদের কাছ থেকে। তবে হুমায়ূন আহমেদের ক্যান্সার ধরা পড়ার পরে তার ধানমণ্ডির দখিন হাওয়া অ্যাপার্টমেন্টের বাসায় মেয়ে শীলা, নোভা ও বিপাশা আহমেদ অসুস্থ বাবাকে দেখতে গিয়েছিলেন বলে জানা গেছে। হুমায়ূন আহমেদ ক্যান্সারে আক্রান্ত হওয়ার পর স্বামী ও সন্তানসহ মেয়েরা একবারই দেখতে গিয়েছিলেন বলে জানা গেছে। হুমায়ূন-গুলতেকিন দম্পতির একমাত্র পুত্র নুহাশ আহমেদ অবশ্য তার বাবাসহ অন্যদের সঙ্গে যোগাযোগ রেখেছিলেন বড় হওয়ার পর থেকেই। সৌজন্যে: বাংলানিউজডটকম।