ঢাকা টাইমস্ ডেস্ক ॥ মানুষ যখন বৃদ্ধ হয়ে যায় তখন তার আর কোন মূল্যই যেনো থাকে না। অন্তত বৃদ্ধাশ্রমগুলোতে গেলে তাই মনে হয়। কয়েকবছর আগে আমি একবার গিয়েছিলাম গাজীপুরের একটি বৃদ্ধাশ্রমে। সেখানে বৃদ্ধদের দেখলে অজান্তেই নিজের মধ্যে কম্পন শুরু হয়। মানুষ কি করে পারে নিজের আপনজনকে ফেলে বাঁচতে?
প্রবীণ হিতৈষী সংঘ। আযান হবে আর একটু পরে। সামনে চিড়া, টক দৈ, কলা। হাতে এক গ্লাস পানি নিয়ে বসে আছেন ইফতার করবেন তিনি। ঘুরে একবার পেছনে দেখলেন। সঙ্গী কেউ নেই। আর এক রুমে দুজন নারী দুই খাটে ইফতার নিয়ে বসেছেন। তাঁরা কেও কারো আত্মীয় নন। আরেক কক্ষে দেখা গেল তিন-চারজন এক হয়ে বসেছেন। এরা সবাই প্রবীণ নিবাসের বাসিন্দা। যাঁরা নিজ নিজ ক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠিত ছিলেন একদিন। সন্তানদের মানুষও করেছেন। জীবনের কোনো দায়িত্ব থেকে পালিয়ে বাঁচার চেষ্টা করেননি।
গতিময় জীবনের সাথে তাল মেলাতে ভাঙছে পারিবারিক বন্ধন। জীবনের শেষ প্রান্তে এসে তাঁদের বেছে নিতে হয়েছে বৃদ্ধাশ্রম! পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন মানুষগুলোও রোজা রাখেন। কেমন হয় তাদের পরিবার ছাড়া ইফতার, তাই দেখতে আগারগাঁও-এ অবস্থিত এই সরকারি বৃদ্ধাশ্রমে যাওয়া।
বৃদ্ধাশ্রমে আশ্রিতদের কেও সরকারের আমলা ছিলেন, কেও কলেজের অধ্যক্ষ, কেওবা সৃজনশীল প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা। পরিবারের সাথে ব্যক্তিত্বের সংঘাতে, মেয়ের বাড়িতে না থাকার অজুহাতে, আবার কেবলই একা থাকার অভিশাপ থেকে মুক্ত হয়ে থাকতে চান বলে আশ্রয় নিয়েছেন আগারগাঁও প্রবীণ হিতৈষী সংঘের প্রবীণ নিবাসে।
জানা গেল এখানে থাকা ৪০ জনের মধ্যে ২০ জন নারী। তাঁদের ৩০ জনের মতো এক সাথে মেস্ করে খান। একজন ম্যানেজার হন। তাঁর দায়িত্ব বাজার করা। রোজার মাস বলে ইফতার আর সেহেরির বাড়তি দায়িত্ব তাকেই পালন করতে হয়। নিজেরাই লোক রেখে রান্না করান। বাকিরা নিজেরাই খাওয়ার ব্যবস্থা করেন।
বৃদ্ধাশ্রমের প্রশাসনিক কর্র্মকতা আশরাফুল আলম মাসুম বলেন, এখানে আশ্রয় নেওয়া বৃদ্ধদের খাওয়া-দাওয়া চিকিৎসাসহ সব ব্যবস্থা আছে। এখন বসবাসকারীরা আর মিডিয়ার মুখোমুখি হতে চান না। ভাবেন তাদের খবর প্রকাশ পেলে সমাজে পরিবারের সম্মান ক্ষুন্ন হবে। মুখ খুলতে চান না কেও। তাঁরা তো কারো দয়া দাক্ষিণ্য নিয়ে বেঁচে নেই। এখানে ভাড়া দিয়ে নিজের টাকা খরচ করে থাকছেন। তবে গল্প করতে শুরু করলে দীর্ঘশ্বাস এড়াতে পারেন না। অনুরোধ করেন নাম পরিচয় গোপন রাখতে। কেও আবার বলেন, ‘এখানে আছি আবার নাও থাকতে পারি, মানুষ তো সব সময় এক জায়গায় থাকে না।’ আফিয়া খাতুন (ছদ্ম নাম) এক সময় কলেজে ছিলেন। একটা কথাই বললেন, ‘পরিবার ছেড়ে থাকতে কি মানুষের সাধ হয়! আছি ভাগ্যে ছিলো বলে।’ নামাজের পরে যাঁর কাছে গেলাম তিনি চিড়া কলা দিয়ে ইফতার সারলেন। বললেন, ‘পরিবারের কথা অবশ্যই মনে হয়, তাদেরও আমাকে মনে পড়ে। আমার একটাই ছেলে। সে ডাক্তার, বউ মা-ও। বাবা আর ছেলের দ্বন্দ্ব, মা ছেলের পক্ষে। আমার কোন দোষ দেখি না। তাই কমেপ্রামাইজের প্রশ্ন আসে না। স্ত্রী ফোন করে জানিয়েছে আমি দাদা হয়েছি। শুনলাম। ওকে ফোন করতে বারণ করি। প্রতিদিনই ফোন করে, ধরি না। চার বছরে একবার আমাকে দেখতে পর্যন্ত এলো না। ঈদ রোজার নিয়ম মানা ছাড়া অন্যদিনের সাথে কোন পার্থক্য নেই, যা ছিলো পারিবারিক জীবনে। ভাবি ওই জীবনটা সত্যি ছিলো, নাকি এটা।’
অভিমানের পাল্লাটা সবারই ভারী। কেও আবার অতি স্নেহকাতর হয়ে বলেছেন, ‘কারো প্রতি কোন অভিযোগ নেই। ইচ্ছে করেই থাকছি। এখানে থাকতে ভালোই লাগছে।’
ইফতার করার সময় প্রায়ই হারিয়ে যান স্মৃতিতে। হাতড়ে বেড়ান আনন্দের সম্বলটুকু, তবে সবকিছু ছাপিয়ে পেরে ওঠেন না। একাকিত্বের কষ্ট কখনো বুকে জমাট বাঁধে। আবার কখনো তা অশ্রু হয়েও ঝরে পড়ে। নিজেদের মধ্যে তারা হাসি ঠাট্টায় মাতেন কখনো। দেখা হল প্রবীণতম আতিকুর রহমানের সাথে, বয়স ৯৬ বছর। তিনি এখানে আছেন দশ বছর। ক্র্যাচ ছাড়া হাঁটতে পারেন না। সবসময় পেটের অসুখ লেগেই আছে। হাতে দুটো ক্যাপসুলের খালি পাতা নিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছেন কাওকে দিয়ে দোকান থেকে ওই ওষুধ আনাবেন বলে। গল্প করার শর্তে তাঁর ওষুধ এনে দিলাম। তারপর বললেন, সারাদিন একা থাকতে ভালো লাগে না, কেও তাঁর কথা শুনতে চায় না। ফাতেমা নামের এক নারী তাকে অর্থের বিনিময়ে সাহায্য করে। রমযান মাসের কথা তুলতেই বললেন, ‘রোজা রাখতে পারি না, ওরা ইফতারও দেয় না। গত শনিবার একটি প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয় থেকে তাদের ইফতার পাঠিয়েছে। তখন ফল খেয়েছি।’ পরিবারের সবার সাথে ইফতার করা দিনগুলো তার কাছে দুঃস্বপ্নের মতো লাগে।
ঈদ বলে আলাদা কোনো দিন নেই এখন আর। প্রতিটা দিনই তাঁর কাছে একই রকম। সকাল, দুপুর আর রাতের মধ্যে দিয়ে সময় পার করে চলা। আর কখন উপরের ডাক আসে তার অপেক্ষা করা…।
(দৈনিক ইত্তেফাকের লেখাটি পড়ে আমার সেদিনের গাজীপুরের বৃদ্ধাশ্রমের কথাটি বার বার মনে পড়লো। আর তাই লেখাটি প্রকাশ করলাম)।