দি ঢাকা টাইমস্ ডেস্ক ॥ এক সময়ের সেই কাঁসা শিল্প এখন আর নেই। এখন আধুনিক যুগ আসার সাথে সাথেই বদলে গেছে সবকিছু। এখন কাঁচ, মেলামাইন, প্লাষ্টিক বা স্টীলের সামগ্রীতে দেশ ছেয়ে গেছে। এখন যেটুকু রয়েছে তা পিতলের ভাস্কর্য। ধামরাইয়ের সুকান্তের পিতলের ভাস্কর্য নিয়েই তৈরি হয়েছে আজকের এই প্রতিবেদন।
এক সময় টুংটাং শব্দে ঘুম ভাঙতো ঢাকার ধামরাইবাসীর। আর এই শব্দ আসত উপজেলার ৩৩টি গ্রামের দুই শতাধিক কাঁসা-পিতলের কারখানা থেকে। ওই সময় ধামরাইয়ের ঐতিহ্যবাহী কাঁসা-পিতলের জিনিসপত্রের কদরও ছিল বেশ। ধীরে ধীরে দেশে প্লাস্টিক, অ্যালুমিনিয়াম ও স্টিলের তৈরি সামগ্রীতে বাজার ছেয়ে যাওয়ায় কাঁসা-পিতলের চাহিদা কমতে থাকে। বর্তমানে লাভের চেয়ে লোকসান বেশি হওয়ায় মালিকরা একের পর এক কারখানা বন্ধ করে দিচ্ছেন। এর সঙ্গে জড়িত শ্রমিকরাও এ পেশা বদলাচ্ছেন। এভাবেই বিলুপ্ত হচ্ছে ধামরাইয়ের ২০০ বছরের ঐতিহ্যবাহী কাঁসা-পিতল শিল্প। আর তাই এখন আর আগের মতো টুংটাং শব্দে ধামরাইবাসীর ঘুম ভাঙে না। তবু বাপ-দাদার পেশাকে আঁকড়ে ধরে রেখেছেন ধামরাইয়ের বিশ্বকর্মা খ্যাত সুকান্ত বণিক।
ধামরাই পৌর বাজার সড়কের দু’পাশে সারিবদ্ধ ব্রিটিশ ধাঁচের পুরনো অর্ধ শতাধিক বাড়ি। বাড়িগুলোর কারুকাজ চোখ ধাঁধানো। কায়েতপাড়ার বিশাল একটি দোতলা বাড়ির মালিক সুকান্ত বণিক। তার বাড়ির ২৭টি কক্ষের মধ্যে নিচতলার ৭টি কক্ষ নিয়ে গড়ে উঠেছে জাদুঘর বা শোরুম। বর্তমানে তার শোরুমে কাঁসা-পিতলের পুরনো বিশাল ভাস্কর্য, থালা, কলস, বাটি রয়েছে প্রায় ৪০০ প্রকার। পিতলের তৈরি একটি নটরাজ শিবমূর্তি দেখিয়ে সুকান্ত বণিক বললেন, এটা বানাতে সাড়ে তিন মাস লেগেছে। ৪০ কেজি ওজন। দাম ৮০ হাজার টাকা। তার কারখানায় এখন তৈরি হচ্ছে পিতলের শিব, বিষ্ণু, রাধা-কৃষ্ণ, বুদ্ধ মূর্তি, পূজার থালা, ঘড়া, লক্ষ্মী, মাতৃকা মূর্তি, সাপের ওপর রাধা-কৃষ্ণসহ অনেক ভাস্কর্য। সুকান্ত বণিকের নাম দেশে-বিদেশে ছড়িয়ে পড়ায় প্রতিনিয়তই তার কারখানা ও শো-রুম পরিদর্শনে আসেন বিভিন্ন দেশের রাষ্ট্রদূত ও কূটনীতিকরা। এসব মূর্তি ও ভাস্কর্যের বিদেশে ব্যাপক চাহিদা থাকার পরও কাস্টমসের জটিলতায় তা রফতানি করা সম্ভব হচ্ছে না। সরকারের সহযোগিতা থাকলে এসব মূর্তি ও ভাস্কর্য রফতানি করে বিপুল পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন সম্ভব বলে জানালেন সুকান্ত বণিক।
সুকান্ত আরও বলেন, কাঁসা-পিতল আমার পারিবারিক ব্যবসা। প্রায় পাঁচ প্রজন্ম ধরে এ ব্যবসা। অন্তত ২০০ বছর। পিতল ও কাঁসার ভাস্কর এ তরুণ তার তিন প্রজন্মকে স্মরণ করে বলেন, শরৎচন্দ্র বণিক আমার দাদার বাবা; লালমোহন বণিক আমার দাদা এবং ফণিভূষণ বণিক আমার বাবা। আমাদের এই বাড়িটি দাদার বাবা শরৎচন্দ্র বণিকের করা। ভারত ভাগের পর কাঁসা-পিতল শিল্পে যত বণিক কারিগর ছিলেন, তারা মানসিকভাবে একটা চাপে পড়ে যান। কারণ তারা অধিকাংশই ছিলেন হিন্দু। তারা ১৯৪৭ সালে দেশ ভাগের সময় ভারত চলে গেছেন। পরে একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধের সময় আমরাও সবাই ভারতে চলে যাই। ৭২-এ ফিরে আসার পর আবার ব্যবসা শুরু করি। যারা লুটপাট করেছিল, তাদের কাছ থেকেই আবার আমরা আমাদের জিনিসপত্র কিনে নিয়েছি। এরপর ১৯৭৮ থেকে ১৯৯০ পর্যন্ত ব্যবসা মোটামুটি ভলো ছিল। ১৯৯০ থেকে ২০০০ সাল পর্যন্ত অবস্থা আবার খারাপ হয়ে যায়। তারপরও হাল ছাড়িনি। কাঁসা-পিতলের টুংটাং হাতুড়ি পেটানোর শব্দে আমি বড় হয়েছি। এ ব্যবসা আমার রক্তে মিশে গেছে। এর খারাপ অবস্থা আমি মানতেই পারিনি। অন্য কোনো পেশায় নিজেকে না জড়িয়ে তাই আমি ঠিক করি, এটাকেই পেশা, নেশা, ধ্যানজ্ঞান হিসেবে নেব। কীভাবে অবস্থার পরিবর্তন করা যায় ভাবতে থাকি। আগে ছিল শুধু কাঁসার বাণিজ্য। কাঁসা-পিতলের সামগ্রী বানানোর কোনো কারখানা ছিল না। পাশের গ্রাম থেকে কারিগর দিয়ে বানিয়ে এনে বিক্রি করা হতো। আমিই প্রথম ২০০০ সালে বাবার কাছ থেকে দায়িত্ব বুঝে নেওয়ার সময় ঠিক করি, এখানে কারিগরি ও বাণিজ্য দুটোই করব। এখন আর আগের মতো কাঁসা-পিতলের থালা-বাটি-ঘটির চাহিদা নেই। এখন পুরোপুরি ভাস্কর্য আর ডেকোরেটিভ ডিজাইনের ওপরই কাঁসা-পিতল শিল্পের আগ্রহ। আমরা অ্যান্টিক ও ডেকোরেটিভ আইটেম বাড়িয়ে দিলাম। চার ভাইয়ের মধ্যে সুকান্ত সবার ছোট। ২০০০ সালে সাভার ডিগ্রি কলেজ থেকে রাষ্ট্রবিজ্ঞানে স্নাতকোত্তর পড়াশোনা শেষ করেন সুকান্ত। বাকি তিন ভাই এখন ভারতে।
সুকান্ত বণিক বলেন, ১৯৬৮ সাল থেকেই ধামরাইয়ের কাঁসা-পিতল শিল্প বিদেশিদের কাছে পরিচিতি হয়ে উঠলেও ব্যাপক আগ্রহ তৈরি হয় ২০০০ সাল থেকে। আর এ ক্ষেত্রে ভূমিকা রাখেন লালমাটিয়ার মিনোনাইট সেন্ট্রাল কমিটি (এমসিসি) নামে একটি বেসরকারি সংস্থার কিছু আমেরিকান, রেডক্রসের সে সময়কার কান্ট্রি ডিরেক্টর আর ফ্রিডম্যান। এরপর ২০০১ সালে একটি সাংস্কৃতিক দলের সঙ্গে আমেরিকায় যাওয়ার সুযোগে বিদেশিদের কাজ দেখানোর ক্ষেত্র তৈরি করে দেয়। বিদেশিরা দেখে এত মুগ্ধ হন যে, তারা অন্যদের বলতে থাকেন ধামরাইয়ের কাঁসা-পিতল শিল্প আর সুকান্ত বণিকের কথা। এখন তো আমেরিকান, ব্রিটিশ, ডাচরাই প্রধান ক্রেতা। বিদেশিদের মধ্যে বিভিন্ন ধরনের বৃদ্ধ যেমন জাপানি, নেপালি, ভারতীয় নাগরিক। হিন্দু ও বৌদ্ধ ধর্মীয় এবং পৌরাণিক চরিত্র যেমন বুদ্ধ, শিব, বিষ্ণু, রাধা-কৃষ্ণ অষ্টধাতুর তৈরি এসব মূর্তির খুব চাহিদা। তারা ধর্মীয় জায়গা থেকে কেনে না। ওরা কেনে এর গল্প, কারুকাজ আর কারিগরি দক্ষতা দেখে। আমরা যে পদ্ধতি ব্যবহার করে ভাস্কর্য বা থালা-বাটি বানাই, এটা কিন্তু বিদেশ থেকে আনা নয়; একেবারেই দেশীয় লোক ঐতিহ্য। হাজার বছরের অভিজ্ঞতা পরম্পরায় তৈরি হয়েছে এসব।
সুকান্ত বণিক জানান, ধামরাইয়ে যে ভাস্কর্য তৈরি করা হয়, তার কাজের পদ্ধতিটি হলো লস্ট ওয়াক্স পদ্ধতি। এটা একেবারেই লৌকিক পদ্ধতি। পদ্ধতিটি এমন যে, এ পদ্ধতিতে একটা ভাস্কর্য একবারই বানানো সম্ভব। বারবার সম্ভব নয়। সে কারণে প্রতিটি ভাস্কর্যই অনন্য এবং অসাধারণ। এই পদ্ধতির কারণে বিদেশিদের কাছে আগ্রহটাও বেশি। সুকান্ত জানান, বিভিন্ন দেশ থেকে ক্রেতারা প্রায়ই তার কারখানার মূর্তিসহ বিভিন্ন জিনিসপত্র কিনতে আসেন। তবে কাস্টমস জটিলতার কারণে অনেক সময় কিনতে চান না। পিতলের তৈরি এসব মূর্তির পেছনে ধামরাইয়ের কথা লেখা থাকার পরও কাস্টমস কর্মকর্তারা মনে করেন, বাংলাদেশ থেকে বিভিন্ন ধাতব মূর্তি পাচার হয়ে যাচ্ছে। এ কারণে ক্রেতারা কিনে নিজ দেশে নিতে ঝামেলায় পড়েন।
সুকান্ত বণিকের কারখানায় কারিগরসহ ১২ জন শ্রমিক কাজ করছেন। নন্দ সরকার আর নিরঞ্জন মণ্ডল দু’জনই কারিগর। নন্দ ৭ বছর আর নিরঞ্জন ৯ বছর ধরে কাজ করছেন। তারা জানান, প্রতিদিন মজুরি হিসেবে তাদের ২৫০ টাকা দেওয়া হয়। নিরঞ্জন জানান, তার হাতের বুদ্ধ মূর্তির মাথার কারুকাজ করতে সময় লাগে ২ থেকে ৩ মাস। আর এর দাম হবে ৬৫ হাজার টাকা। সুকান্ত বণিক বলেন, ধামরাইয়ের এই পিতলের ভাস্কর্য বিদেশিরা বিনা বাধায় নিজ নিজ দেশে নেওয়ার সুযোগ পেলে আমরা ভাস্কর্য শিল্পে বিশ্ব জয় করতে পারি। তিনি এ ব্যাপারে সরকারের সুদৃষ্টি কামনা করেন। (তথ্যসূত্র: দৈনিক সমকাল)