দি ঢাকা টাইমস্ ডেস্ক ॥ সুন্দরী হতে কে না চাই? আর এই সুযোগে রাতারাতি ত্বক ফর্সা করার প্রলোভন দেখিয়ে হরেক নামের প্রসাধন সামগ্রী বাজারে ছেড়ে অসহায় মানুষদের বিপদের পথে ঠেলে দিচ্ছে প্রতারক চক্র। বাজার ধরতে নামীদামি তারকাদের দিয়ে তৈরি করানো ওইসব পণ্যের সস্তা বিজ্ঞাপনে চোখ আটকে যাচ্ছে সরলমনা মানুষের- বিশেষ করে মহিলাদের।
অল্প সময়ে ‘ভেলকি’ দেখাতে মানহীন পণ্যসামগী বাজারে ছেড়ে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে প্রতারক চক্র। মুদি দোকানেও মিলছে এসব পণ্য। আর কসমেটিকস দোকানের বাইরে বিউটি পার্লারগুলো এদের বিশেষ টার্গেট থাকে। সহজ-সরল মানুষদের ত্বক ফর্সা করার নামে ড়্গতিকারক সব উপাদান দিয়ে তৈরি পণ্য বাজারজাত করে আঙুল ফুলে কলাগাছ হয়েছে অনেকেই। বিএসটিআই, র্যাবের ভ্রাম্যমাণ আদালত ও ওষুধ প্রশাসন অধিদপ্তরের ঢিলেঢালা অভিযানের সুযোগে পার পেয়ে যাচ্ছে সংশিস্নষ্টরা। অভিযোগ রয়েছে অনেককে ‘ম্যানেজ’ করেই চালাচ্ছে রকমারি এ ব্যবসা। এমনকি দেশী-বিদেশী নামীদামি পণ্যের নকল পণ্য তৈরি ও বাজারজাতের সঙ্গেও একই চক্র জড়িত বলে একাধিক সূত্র দাবি করেছে।
এসব ক্রিম ব্যবহারে অল্প সময়ে ত্বকের পরিবর্তন ঘটলেও কিডনি, হাত-পা অবশ হওয়া, গর্ভবতী মায়ের সনত্মানের মস্তিষ্ক গঠন বাধাগ্রসত্ম হওয়া, প্রতিবন্ধী সনত্মানের জন্ম, মুখম-লের ত্বক পুড়ে যাওয়া এবং চর্মসহ নানা রোগে এমনকি ক্যান্সারেও আক্রানত্ম হচ্ছেন ব্যবহারকারীরা।
সূত্র মতে, হাজারীবাগ ও কেরানীগঞ্জে ওইসব কোম্পানির লেবেল নকল করে দেশে তৈরি নিম্নমানের ক্রিম ভরে এসব বিক্রি করা হচ্ছে। ত্বক ফর্সা করার ক্রিম ছাড়াও বোটানিক কোম্পানিগুলো সুগন্ধি তেল, ব্যথা মালিশ, মেছতা দূর, চুলপড়া রোধ, মেহেদি, যৌনরোগ, অতিরিক্ত মেদ এবং ওজন কমানোসহ নানা ধরনের হারবাল ওষুধ বিক্রি করছে। চীন ও ভারত থেকে চোরাইপথে মানহীন ত্বক ফর্সার ক্রিম আসছে। রাজস্ব বিভাগ বা বাংলাদেশ ব্যাংকে কোনো কোম্পানি হারবাল সামগ্রীর কাঁচামাল আমদানি করেছে বলে রেকর্ড নেই। সরাসরি ক্রিম আমদানিরও এলসির তথ্য নেই। অথচ দেশের বাজারে ভারত, চীন ও থাইল্যান্ডের হারবাল ক্রিমের ছড়াছড়ি। হারবাল ব্যবসার ক্ষেত্রে বিদেশী নাম ব্যবহার
করা দণ্ডনীয় অপরাধ হলেও প্রতারক চক্র ইন্ডিয়া হারবাল, কলিকাতা হারবাল, আমেরিকান হারবাল, কোরিয়ান হারবাল, চাইনিজ হারবাল, থাই হারবাল নাম ব্যবহার করছে। বিভিন্ন হারবাল চিকিৎসাকেন্দ্রে প্রতারকরা রাজনীতিবিদ, দেশের বড় বড় তারকা, মডেলসহ সমাজের বিশিষ্ট ব্যক্তিদের সঙ্গে তাদের ছবি দেয়াল বা টেবিলে বাঁধাই করে রাখছে।
সম্প্রতি র্যাবের অভিযানে বোটানিক এ্যারোমা, রোজ কসমেটিকস, জনশক্তি হারবাল, ক্যাপিটাল হারবাল, সুমন এরোমা, শ্রীবানিজ এরোমা, লতা হারবাল, জিএম হারবাল, লিজান হারবাল, মমতাজ বোটানিক, নোভিনস এরোমা, বায়োলিফ এরোমা, খুশবো হারবাল, ইতিবৃত্ত হারবাল, শাহজাদী হারবাল, মৌসুমী হারবাল, দীন ইসলাম হারবাল, গোল্ডেন পস্নাস হারবাল, ফেমাস ফার্মাসিউটিক্যালস, সাদেক ফার্মাসিউটিক্যালস থেকে বিপুল পরিমাণ স্টেরয়েড, সিল্ডেনা সাইট্রেট, হাইড্রোক্লোরিক এসিড, মদ, আফিম আটক করা হয়। গ্রেপ্তার করা হয় এসবের সঙ্গে সংশ্লিষ্টদের অনেককে। কিন্তু আটক ব্যক্তিরা পরে জামিনে বেরিয়ে একই অপকর্ম শুরু করেছে। অলিতে-গলিতে অননুমোদিত হারবাল ও এরোমা প্রতিষ্ঠান থাকলেও ওষুধ প্রশাসন অধিদপ্তর কিছুই করছে না।
ওষুধ প্রশাসন অধিদপ্তরের হিসাবে দেশের ওষুধের বাজারের ২৫ শতাংশ ভেষজ ওষুধের নিয়ন্ত্রণে। দেশে আয়ুর্বেদ-ইউনানি ও হারবাল ওষুধ উৎপাদনকারী অনুমোদিত প্রতিষ্ঠান আছে ৪৫০টির মতো। ওষুধ প্রশাসন অধিদপ্তরের সহকারী পরিচালক শফিকুল ইসলাম বলেছেন, এসব ব্যাপার তারা দেখেন না। বিএসটিআই ও র্যাব দেখে থাকে। প্রয়োজনে তারা বিএসটিআই ও র্যাবকে সহায়তা করেন।
শহর গ্রাম মিলিয়ে বিপুলসংখ্যক মানুষ হাঁপানি, চর্ম ও যৌনরোগ, বাত-ব্যথা, রং ফর্সা করা ও মোটা হওয়ার জন্য ভেষজ ওষুধ সেবন করে। এরই সুযোগ নেয় তথাকথিত হারবাল চিকিৎসাকেন্দ্র। বিভিন্ন সময় হাঁপানির ওষুধে উচ্চমাত্রায় স্টেরয়েড, মোটা হওয়ার ওষুধে পেরিএকটিন, যৌনক্ষমতা বৃদ্ধির ওষুধে সিল্ডেনা সাইট্রেট, ফর্সা হওয়ার ক্রিমে স্যালিসাইলিক এসিড, দাঁত পরিষ্কার করার ওষুধে হাইড্রোক্লোরিক এসিড পাওয়া গেছে। ওষুধে আফিম এমনকি মদও ব্যবহার হচ্ছে। স্টেরয়েড জীবনরক্ষাকারী উপাদান হলেও এর অতিরিক্ত মাত্রায় জীবন বিপন্ন হয়। সিল্ডেনা সাইট্রেট ‘ভায়াগ্রা’ তৈরির একটি উপাদান, যা বাংলাদেশে নিষিদ্ধ। পেরিএকটিন সাধারণত ব্যবহার হয় গরম্ন মোটাতাজা করতে। এটি মানুষের কিডনির জন্য বেশ ক্ষতিকর। হাঁপানি-শ্বাসকষ্ট রোগে স্টেরয়েড সেবনে তাৎক্ষণিক আরাম হয়। দীর্ঘমেয়াদে রোগী উচ্চ রক্তচাপ, ডায়াবেটিসে আক্রানত্ম হয়। হাড় ক্ষয় হয়ে এতো দুর্বল হয় যে, একটু চোটেই ভেঙে যায়। স্টেরয়েড ব্যবহারের কারণে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতাই নষ্ট হয়ে যায়।
বিএসটিআই সূত্র মতে, মেয়াদ উত্তীর্ণ ক্রিম কিনে সাদা কৌটায় ভরে বিউটি পার্লারগুলোতে চড়া দামে বিক্রি করা হচ্ছে। অনেক সময় ফেয়ার অ্যান্ড লাভলি, পন্ডস ও নোভা ক্রিম একসঙ্গে মিশিয়ে নতুন নামে বিক্রি করা হচ্ছে। নামীদামি এবং আনত্মর্জাতিকভাবে স্বীকৃত কোম্পানিগুলোর ক্রিমও নকল হচ্ছে। মেহেদিতে উচ্চমাত্রার কেমিক্যাল ব্যবহার করায় পাঁচ মিনিটেই সহজাত উজ্জ্বল রঙ হয়। কেমিক্যালযুক্ত মেহেদি ব্যবহারে দীর্ঘমেয়াদে ত্বকে এক ধরনের ক্যান্সার সৃষ্টি করতে পারে বলে চিকিৎসকরা জানিয়েছেন। অধিকাংশ হারবাল প্রসাধনী কোম্পানির নেই কোনো একাডেমিক স্বীকৃতি, নেই কোনো লাইসেন্স।
কনজিউমারস এসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) এক জরিপে বলা হয়েছে, শতকরা ৪৫ ভাগ প্রসাধন পণ্যের বিএসটিআইয়ের সনদ নেই, ৭৫ ভাগ পণ্যের উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানের ঠিকানা নেই।
বিএসটিআইয়ের মহাপরিচালক ফজলুল আহাদ বলেছেন, ত্বক ফর্সাকারী ক্রিমের নামে বাজারে ড়্গতিকারক সামগ্রী বিক্রি হচ্ছে ুোর- এমন অভিযোগে বাজার থেকে বিভিন্ন ধরনের ক্রিম সংগ্রহ করা হয়েছে। এতে অনেক ড়্গতিকারক পণ্য পাওয়া গেছে। যা অনেক জটিল রোগের কারণ। ওইসব পণ্যের বিরম্নদ্ধে শিগগিরই ভ্রাম্যমাণ আদালত অভিযান পরিচালনা করবে। তিনি বলেন, লাইসেন্স ছাড়া প্রতিষ্ঠান তো বটেই লাইসেন্স নিয়েও অনেক প্রতিষ্ঠান নিয়মের বাইরে রাসায়নিক পণ্য ব্যবহার করছে। এসবের নমুনা সংগ্রহ করে ল্যাবে পরীড়্গা করে ক্ষতিকারক উপাদন পাওয়া গেছে। মানহীন এসব পণ্য বাজার থেকে বাজেয়াপ্ত ও কোম্পানি সিলগালা করা হবে।
র্যাবের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট এ এইচ এম আনোয়ার পাশা বলেছেন, সারা দেশে রঙ ফর্সা ক্রিমের বিশাল বাজার তৈরি হয়েছে। অল্প সময়ে ম্যাজিকের মতো কালো ত্বককে ফর্সা করার বিষটি নজরে এনে র্যাব অনুসন্ধানে নামে। বাজার থেকে এসব পণ্যের নমুনা সংগ্রহ করে পরীক্ষার জন্য এটোমিক এনার্জি সেন্টার, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল ইউনিভার্সিটি ও বাংলাদেশ পরমাণু শক্তি কেন্দ্রে পাঠানো হয়। তাদের দেয়া রিপোর্টে দেখা গেছে এরোমা ক্রিমে মাত্রাতিরিক্ত ক্ষতিকারক ও ঝুঁকিপূর্ণ মার্কারি (পারদ) ব্যবহার করা হচ্ছে। যার ফলে অল্প সময়ে গায়ের ত্বকের রঙের পরিবর্তন ঘটলেও ব্যবহারকারী আক্রানত্ম হচ্ছেন কিডনি রোগে, হাত-পা অবশ, গর্ভবতী মায়ের গর্ভের সন্তানের মস্তিষ্ক গঠন বাধাগ্রস্ত হয়ে প্রতিবন্ধী সনত্মানের জন্ম হয়, চর্মসহ নানারোগে আক্রানত্ম হয়। তিনি আরো জানান, সারা বিশ্বে ক্ষতিকারক মার্কারিযুক্ত ক্রিম ব্যবহার নিষিদ্ধ। ‘ভেলকি’ দেখাতেই এসব কোম্পানি বাহারি বিজ্ঞাপন দিয়ে প্রতারণার জাল বিস্তৃত করে থাকে। (সৌজন্যে : দৈনিক ভোরের কাগজ)।