দি ঢাকা টাইমস্ ডেস্ক ॥ আলোচিত যুবলীগ নেতা রিয়াজুল হক খান মিল্কী হত্যাকাণ্ডে জড়িত সন্দেহভাজন জাহিদ সিদ্দিক তারেকসহ দু’জন র্যাবের সঙ্গে ‘ক্রসফায়ারে’ নিহত হয়েছেন। গতকাল বুধবার রাত ১০টার দিকে রাজধানীর খিলগাঁও ওভার ব্রিজের কাছে এ ঘটনা ঘটে।
জানা যায়, তারেকের সঙ্গে নিহত অপর জনের নাম শাহ আলম। জাহিদ সিদ্দিক তারেক ঢাকা মহানগর যুবলীগ দক্ষিণের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক।
র্যাবের গোয়েন্দা শাখার পরিচালক জিয়াউল আহসানের উদ্বৃতি দিয়ে একটি সংবাদ মাধ্যম বলেছে, গুলিবিদ্ধ জাহিদ সিদ্দিক তারেক রাজধানীর উত্তরায় একটি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন ছিলেন। তাঁকে গুলশান থানায় হস্তান্তরের জন্য নেওয়া হচ্ছিল। রাত ১০টার দিকে তাঁকে বহনকারী গাড়িটি খিলগাঁও ওভার ব্রিজের কাছে পৌঁছালে তারেককে ছিনিয়ে নিতে তার সহকর্মীরা হামলা চালায়। এ সময় পালাতে গেলে দুই পক্ষের মধ্যে ‘বন্দুকযুদ্ধে’ নিহত হন তারেকসহ দুজন। এতে র্যাবের দুই সদস্য আহত হয়েছেন বলে জিয়াউল আহসান দাবি করেন।
এর আগে রিয়াজুল হক খান মিল্কী হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত থাকার অভিযোগে জাহিদ সিদ্দিকী তারেক ও ঢাকা মহানগর যুবলীগ উত্তর সাংগঠনিক সম্পাদক সাখাওয়াত হোসেন চঞ্চলকে যুবলীগ বহিস্কার করে।
গত ২৯ জুলাই রাতে গুলশানের শপার্স ওয়ার্ল্ড নামের একটি বিপণিকেন্দ্রের বাইরে মিল্কিকে গুলি করে হত্যা করা হয়। পরে ওই বিপণিকেন্দ্রের গোপন ক্যামেরায় ধারণ করা দৃশ্য দেখে জাহিদ সিদ্দিকী তারেকসহ ছয়জনকে গ্রেফতার করে র্যাব।
এদিকে ২৯ জুলাই রাতে মাত্র ১৪ সেকেন্ডে এ ভয়ঙ্কর মিল্কি হত্যাকাণ্ডের ঘটনা ঘটে। মিল্কি হত্যার এ মর্মান্তিক দৃশ্য প্রত্যক্ষ করেন মার্কেটের ক্রেতা ও পথচারীরা। মিশন শেষ করে মোটরবাইকে ঘটনাস্থল ত্যাগ করে চার যুবক। ২৯ জুলাই মধ্যরাতের শ্বাসরুদ্ধকর এই ১৪ সেকেন্ডের দৃশ্যটি ধরা পড়ে শপার্স ওয়ার্ল্ডের ক্লোজ সার্কিট ক্যামেরায়। হত্যাকাণ্ডের পরপরই ভিডিও ফুটেজটি জব্দ করে র্যাব।
শপার্স ওয়াল্ডের সিসি ক্যামেরায় ধারণ করা চিত্রে দেখা যায়, প্রাইভেটকার থেকে মিল্কি নামার পর সাদা পাজামা-পাঞ্জাবি ও টুপি পরা এক যুবক বাম কানে মোবাইলে কথা বলতে বলতে মিল্কির সামনে এসে ডান হাতে ছোট আগ্নেয়াস্ত্র দিয়ে প্রথমে একটি গুলি করেন। গুলিবিদ্ধ মিল্কি বাম দিকে হেলে মাটিতে পড়ে হামাগুঁড়ি দিতে থাকেন। ওই সময় ওই যুবক মিল্কিকে লক্ষ্য করে আরও সাত/আটটি গুলি ছোঁড়েন। এরপর পেছন থেকে এক যুবক মোটর সাইকেল চালিয়ে এলে গুলিবর্ষণকারী যুবক ওই মোটর সাইকেলের পেছনে বসে চলে যায়। ওই সময় আরেক যুবককেও গুলি ছুড়তে দেখা যায়।
বাংলাদেশনিউজ২৪ডটকমের খবরে আরও বলা হয়েছে, সাদা পাঞ্জাবি পরা যে যুবকটিকে গুলি ছুড়তে দেখা যায়, সেই ব্যক্তিটি ছিল তারেক। কিলিং মিশনে সরাসরি অংশগ্রহণকারী একজনের গুলিতে তারেক আহত হয়। তার সহযোগীরা গুলিবিদ্ধ তারেককে রাজধানীর একটি হাসপাতালে ভর্তি করে। এ সময় তারেককে মহানগর উত্তর যুবলীগের সাংগঠনিক সম্পাদক চঞ্চলসহ কয়েকজন পাহারা দিচ্ছিল। খবর পেয়ে ওই হাসপাতাল থেকে তারেককে গ্রেফতার করা হয়। পরে অভিযান চালিয়ে আরও পাঁচজনকে গ্রেফতার করা হয়। জিজ্ঞাসাবাদে তারেক হত্যাকাণ্ডের কথা স্বীকার করে। একই সঙ্গে হত্যার সঙ্গে জড়িত অন্যদেরও শনাক্ত করা হয়েছে। এ মামলায় তুহিনুর রহমান, সৈয়দ মোস্তফা আলী রুমি, মোহাম্মদ রাশেদ মাহামুদ, সাইদুল ইসলাম ওরফে নুরুজ্জামান, মোহাম্মদ সুজন হাওলাদার ও জাহাঙ্গীর ম-ল নামের ৬ জনকে গ্রেফতার করা হয়।
মিল্কি হত্যার নেপথ্যে…
ব্যক্তি পর্যায়ের বহুমুখী বিরোধেই খুন হয়েছেন ঢাকা মহানগর যুবলীগ দক্ষিণের সাংগঠনিক সম্পাদক রিয়াজুল হক খান মিল্কি। এ বিরোধের সঙ্গে ঠিকাদারির ভাগ-বাটোয়ারা, চাঁদাবাজি, মতিঝিল এলাকার প্রভাব, দলের ভেতরে ও বাইরে নানা খবরদারিসহ বিভিন্ন কারণ যুক্ত রয়েছে। আর দীর্ঘদিনের বহুমুখী বিরোধের সূত্রে যুবলীগ নেতা জাহিদ সিদ্দিকী তারেক নেতৃত্ব দিয়েছেন এ হত্যাকাণ্ডে। হত্যাকাণ্ডের তদন্তে যুক্ত কর্মকর্তারা এ রকমটাই ধারণা করছেন। ইতিমধ্যে গ্রেফতারকৃতদের জিজ্ঞাসাবাদসহ নানাভাবে তাঁরা এ সংক্রান্ত তথ্য-প্রমাণ পেয়েছেন বলে জানিয়েছেন।
মিল্কির হাত ধরেই তারেকের উত্থান
রিয়াজুল হক খান মিল্কি ছিল গুরু। তার হাত ধরেই শিষ্য তারেক রাজনীতিতে পথচলা শুরু করে। অর্থবিত্ত আর ক্ষমতা অর্জনে ছিল দু’জনের মধ্যে তীব্র লড়াই। ক্ষমতার এই দ্বন্দ্বেরই বলি মিল্কি। এ মিল্কিও ছিল এক সময়ের ফ্রিডম পার্টির ক্যাডার। তার হাত ধরেই অপরাধ জগতে পা বাড়ায় তারেক। তাদের দীর্ঘ কুড়ি বছরের সখ্যের কথা জানে মতিঝিল এলাকার মানুষ। কেও কেও তাদেরকে গুরু-শিষ্য বলেও আখ্যা দেন। একই সঙ্গে যুবলীগের রাজনীতিতে প্রবেশ করে দু’জনই। শিক্ষা বা আদর্শ নয় অ স্ত্র এবং পেশিশক্তিই ছিল তাদের পদ-পদবি পাওয়ার বড় মাধ্যম। রিয়াজুল হক খান মিল্কির গ্রামের বাড়ি কিশোরগঞ্জে, তারেকদের আদি বাড়ি বৃহত্তর ফরিদপুরে। মিল্কির পিতা পেশায় ছিলেন আয়কর আইনজীবী। তারেকের পিতা রাজস্ব ভবনের চতুর্থ শ্রেণীর কর্মচারী। তাদের সখ্য ছিল মতিঝিল কেন্দ্রীক- এজিবি কলোনির বাসিন্দা হিসেবে। সেখান থেকেই তাদের রাজনীতি এবং অপরাধ জগতের হাতেখড়ি। এইচএম জাহিদ সিদ্দিকী তারেকের পড়াশোনার দৌড় অষ্টম শ্রেণী। পড়াশোনা করতো মতিঝিল এলাকার আইডিয়াল ইনস্টিটিউট নামের একটি প্রতিষ্ঠানে। স্কুলের গণ্ডির না পেরিয়েই নাম লেখায় ছাত্র সংগঠনে। নিয়মিত অংশ নিতে থাকে বাকশালের ছাত্র সংগঠন জাতীয় ছাত্রলীগের মিছিলে। সেই থেকে রাজনীতির সড়কে পথচলা শুরু। মিল্কির রাজনীতির শুরু ফ্রিডম পার্টির ক্যাডার হিসেবে। সূত্রমতে, এরশাদ জমানায় মিল্কি ছিল কর্নেল ফারুক-রশিদের ফ্রিডম পাটির মতিঝিল কমিটির সভাপতি। ১৯৯০ সালের গণঅভ্যুত্থানে এরশাদের পতনের পর যোগ দেয় বিএনপিতে। কিন্তু কোন গুরুত্বপূর্ণ পদ না পেয়ে বিএনপি ছেড়ে দেয়। ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর যোগ দেয় যুবলীগের রাজনীতিতে।
আর এভাবেই রাজনৈতিক প্রভাবের বলয়ে নানা অপকর্মে জড়িয়ে পড়ে মিল্কি ও তারেক। ঘটাতে থাকে একের পর এক ঘটনা। আর এভাবেই চলছিল দু’জনের জীবন ও জীবিকা। যার শেষ পরিণতি আজ আমরা দেখলাম। ক্ষমতা ও টাকা মানুষকে কোথায় নিয়ে যেতে পারে তা স্বচোক্ষে দেখা গেলো।