ঢাকা টাইমস্ রিপোর্ট ॥ অবশেষে বিরোধী দলের ৫ এমপির জামিন হয়েছে। গত এক মাস ধরেই দেশজুড়ে যে সংশয় দেখা দিয়েছিল আপাতত তা কিছুটা উপশম হয়েছে। বিএনপি নেতা ইলিয়াস আলী নিখোঁজ হওয়ার ঘটনার পরদিন থেকে হরতালসহ আন্দোলন শুরু হয়।
উল্লেখ্য, হরতালে গাড়ি পোড়ানোর অভিযোগে রাজধানীর তেজগাঁও থানায় দ্রুতবিচার আইনে করা মামলায় বিরোধী দলের পাঁচ সংসদ সদস্যকে ৬ সপ্তাহের অন্তর্বর্তীকালীন জামিন দিয়েছেন হাইকোর্ট। এ মামলায় ১৮ দলীয় জোটের বাকি জ্যেষ্ঠ নেতাদেরও কেন জামিন দেয়া হবে না তা জানতে চেয়ে সরকারের প্রতি আদালত রুল জারি করেছেন। এক সপ্তাহের মধ্যে রাষ্ট্রপক্ষকে এ রুলের জবাব দিতে বলা হয়েছে। বিএনপির ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরসহ বিরোধী দলের ৩৬ নেতার জামিন আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে বিচারপতি সালমা মাসুদ চৌধুরী ও এফআরএম নাজমুল আহাসানের বেঞ্চ ২৭ মে এই আদেশ দেন।
জামিনপ্রাপ্ত ৫ সংসদ সদস্যরা হচ্ছেন- বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য এম কে আনোয়ার, যুগ্ম মহাসচিব ব্যারিস্টার মাহবুব উদ্দিন খোকন, ছাত্রবিষয়ক সম্পাদক শহীদ উদ্দিন চৌধুরী এ্যানি, এলডিপি চেয়ারম্যান অলি আহমদ ও বিজেপির চেয়ারম্যান আন্দালিব রহমান পার্থ।
যাদের ক্ষেত্রে রুল জারি করা হয়েছে তারা হলেন- বিএনপির ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মীর্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর, স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন, মির্জা আব্বাস, ব্রিগেডিয়ার (অব.) হান্নান শাহ, ঢাকার সাবেক মেয়র সাদেক হোসেন খোকা, বিএনপির যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক রুহুল কবীর রিজভী, গয়েশ্বর চন্দ্র রায়, আমান উল্লাহ আমান, কামরুজ্জামান রতন, রুহুল কুদ্দুস তালুকদার দুলু, একেএম ফজলুল হক মিলন, নাজিম উদ্দিন আলম, শফিউল আলম প্রধান, খায়রুল কবির খোকন, কাজী আবুল বাশার, মোঃ আনোয়ারুজ্জামান, নবী সোলায়মান, ইউনুস মৃধা, লুৎফুর রহমান, সাইফুল ইসলাম নীরব, এসএম জাহাঙ্গীর হোসেন সর্দার, রফিকুল ইসলাম মঞ্জু, হাবীবুন্নবী খান সোহেল, মীর সরাফত আলী শপু, ইয়াসিন আলী, সুলতান সালাউদ্দিন টুকু, আমীরুল ইসলাম খান আলীম, আনিসুর রহমান খোকন, হাবিবুর রশিদ হাবিব, আঃ মতিন ও কামাল আনোয়ার।
উল্লেখ্য যে, বিএনপির সাংগঠনিক সম্পাদক এম ইলিয়াস আলীকে গুমের প্রতিবাদে ২৯ এপ্রিল হরতালের সময় প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের সামনে একটি বাসে আগুন দেয়া হয়। ওই ঘটনায় ১৮ দলীয় জোটের ৪৪ শীর্ষ নেতার বিরুদ্ধে তেজগাঁও থানায় দ্রুতবিচার আইনে মামলা করে পুলিশ। এরপর ১০ মে মির্জা ফখরুলসহ ৪৫ জনের বিরুদ্ধে আদালতে অভিযোগপত্র দেয়া হয়। ২১ মে আদালত ওই অভিযোগপত্র গ্রহণ করেন। অভিযোগপত্র দেয়ার আগে পুলিশের ব্যারিকেড ভেঙে হাইকোর্টে আগাম জামিন নেয়ার জন্য নেতারা হাজির হলেও প্রথমে হাইকোর্ট দ্বিধাবিভক্ত আদেশ প্রদান করেন। এরপর ১৪ মে তৃতীয় বিচারপতির বেঞ্চ ১৬ মে’র মধ্যে বিচারিক আদালতে আত্মসমর্পণের নির্দেশ দেন।
সে অনুযায়ী ১৬ মে তারা মহানগর দ্রুতবিচার হাকিমের আদালতে আত্মসমর্পণ করে জামিন চাইলে আদালত তা নাকচ করে তাদের কারাগারে পাঠান। বিএনপির যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী ও কামরুজ্জামান রতনকে আগেই এ মামলায় গ্রেফতার করে কারাগারে পাঠানো হয়। বিএনপির আরেক যুগ্ম মহাসচিব মাহাবুব উদ্দিন খোকন উচ্চ আদালতের জামিন পেলেও মেয়াদ শেষে তাকেও কারাগারে পাঠায় বিচারিক আদালত।
পরে শীর্ষ এসব নেতার পক্ষে মহানগর দায়রা জজ আদালতে জামিনের আবেদন করা হলেও তা খারিজ হয়ে যায়। মহানগর দায়রা জজ আদালত ২৩ মে জোটের ৩৩ নেতার জামিন আবেদন নাকচ করে যে আদেশ দিয়েছিলেন ২৭ মে তার বিরুদ্ধেই হাইকোর্টে আবেদন করেন ওইসব নেতা। সকালে উপরোক্ত বেঞ্চ শুনানির জন্য উত্থাপন করা হলে আদালত তা দুপুরে শুনানির জন্য ধার্য করেন।
দুপুরের শুনানিতে প্রথমেই ব্যারিস্টার মাহবুব উদ্দিন খোকনের আবেদনের শুনানিতে অংশ নেন ব্যারিস্টার রফিক উল হক ও আহসানুল করিম। আহসানুল করিম আদালতে বলেন, বাস পুড়েছে রাত সাড়ে ৯টায়। আমার মক্কেল একজন ব্যারিস্টার ও সংসদ সদস্য। তিনি ওই রাতে বাস পোড়াতে গেছেন। তিনি বলেন, চার্জশিটে এ মামলার আলামত কি ছিল তা দেখার বিষয়। দায়রা জজ আদালত আলামত বিবেচনা করেননি। কারণ, আলামতের ক্ষেত্রে আছে একটি পুরনো বাস যার বেশির ভাগ অংশই পোড়া, এছাড়া সিটের দুই টুকরো পোড়া কাঠ। এর বাইরে কোন আলামত নেই। অভিযোগপত্রে বলা হয়েছে, গাড়ি ভাংচুর ও পোড়ানো হয়েছে। কিন্তু ভাংচুর চালানোর মতো লাঠি বা অগ্নিসংযোগ করার কোন আলামতের কথা চার্জশিটে উল্লেখ নেই।
আহসানুল করিম এফআইআর ও চার্জশিটে বিচ্যুতি আছে উল্লেখ করে বলেন, অভিযোগপত্রে বলা হয়েছে হরতাল সফল করার নিমিত্তে মোবাইল ফোনে একে অপরের সঙ্গে কথা বলে ভাংচুর ও অগ্নিসংযোগ করে। মোবাইল ফোনের কথোপকথন রেকর্ড করা হয়েছে। কিন্তু মোবাইল ফোনের কথোপকথনের রেকর্ডের কোন সিডি আলামত হিসেবে নেই। এ বিষয়টি দায়রা জজ আদালত আমলে নেননি। তিনি আরও বলেন, এফআইআরে বলা হয়েছে ৬-৭টি মাইক্রোবাস থেকে নেমে বাসটি ভাংচুর চালানো ও পোড়ানো হয়েছে। কিন্তু কে নেমেছে, মাইক্রোবাসের নম্বর কত ছিল- এসব ব্যাপারে সুনির্দিষ্ট কোন তথ্য নেই। তিনি দায়রা জজ আদালতের দেয়া আদেশের সমালোচনা করে বলেন, যাবজ্জীবন সাজার বিধান থাকলেও আদালত অভিযুক্তদের অভিযোগের সঙ্গে সম্পৃক্ততা দেখবেন। নথিতে যে অভিযোগ আছে সেটা দেখবেন। কিন্তু দায়রা জজ আদালত তা না দেখে দেখেছেন চার্জশিটে কি আছে। মোবাইল ফোনালাপের যে সিডির ভিত্তিতে আদেশ দিলেন সেই সিডিই নেই। আলামতে সেই সিডির কথা উল্লেখ নেই।
এ সময় আদালত বলেন, এটা মামলা বাতিলের আবেদন নয়। জামিনের কি যুক্তি আছে- সেটা বলেন। এরপর আহসানুল করিম জামিনের যুক্তি তুলে ধরে বলেন, অভিযুক্তের বিরুদ্ধে কোন সুনির্দিষ্ট অভিযোগ নেই। এ মামলায় চার্জশিট হয়ে গেছে। তাই তদন্তে প্রভাবিত করার কোন সুযোগ নেই। এছাড়া জামিন দিলে তিনি পালিয়ে যাবেন না। তিনি একজন সংসদ সদস্য। তাছাড়া সংসদ অধিবেশন শুরু হচ্ছে। এ সময় ব্যারিস্টার রফিক উল হক ইস্ট পাকিস্তান অ্যাসেম্বলি মেম্বার প্রিভিলেজড অ্যাক্ট-১৯৬৫ তুলে ধরে বলেন, এ আইনে বলা আছে, সংসদ অধিবেশনের সাত দিন আগে ও সাত দিন পরে কোন সংসদ সদস্য কোন ধরনের সিভিল ও ক্রিমিনাল মামলায় আদালতে উপস্থিত থাকতে বাধ্য নন। এমপি বিশেষ সুবিধাপ্রাপ্ত ব্যক্তি। এরপর আদালত জানতে চান কতজন এমপি আছেন। তখন ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদসহ অন্যরা বলেন, মোট ৫ জন।
এরপর রাষ্ট্রপক্ষে অতিরিক্ত অ্যাটর্নি জেনারেল এমকে রহমান আদালতে বলেন, দ্রুতবিচার আইনের ১৩ নম্বর ধারায় বলা হয়েছে, ফৌজদারি কার্যবিধিতে যা কিছুই থাকুক না কেন রাষ্ট্রপক্ষকে শুনানি করে এবং সংশ্লিষ্ট নথি পর্যালোচনা করে যদি আদালত যুক্তিসঙ্গত কারণ আছে মর্মে সন্তুষ্টি অর্জন করেন তাহলেই জামিন দিতে পারেন। কিন্তু এখানে কোন নথি নেই। নথি পর্যালোচনারও সুযোগ নেই। তাছাড়া তদন্তে ফোনে কথোপকথনের বিষয়টি এসেছে। এই পর্যায়ে এসে আদালত জামিন দিতে পারে না। আমি মামলার মেরিটে যাচ্ছি না, তবে জামিনের কোন সুযোগ নেই। তিনি রেকর্ড তলব করে রুল জারি করতে আদালতের কাছে আবেদন জানান। এছাড়া এমপিরা এরই মধ্যে কাস্টডিতে। তাই উল্লিখিত আইনের সুযোগ এক্ষেত্রে পেতে পারেন না।
এরপর আদালত বলেন, এমপিদের অন্তর্বর্তী জামিন দিচ্ছি। বাকিদের ক্ষেত্রে রুল। এদিকে আদালত প্রথমে ৫ এমপিকে ছয় মাসের জামিন দিলেও পরবর্তীতে তা পরিবর্তন করে ৬ সপ্তাহ করেছেন। আদালত থেকে বের হয়ে তাই অভিযুক্তদের আইনজীবী ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ ও রাষ্ট্রপক্ষে অতিরিক্ত অ্যাটর্নি জেনারেল সাংবাদিকদের বলেন, আদালত ৫ এমপিকে ছয় মাসের অন্তর্বর্তীকালীন জামিন দিয়েছেন। অবশ্য পরে জানা যায়, আদালত প্রথমে ৬ মাসের জামিন দিলেও পরবর্তীতে তা সংশোধন করে ৬ সপ্তাহ করেন।
অন্যদের কথা উল্লেখ করে এ সময় ব্যারিস্টার মওদুদ বলেন, এভাবে বিভেদ করতে পারেন না। এমপি ও অন্যরা একই জিনিস। তাছাড়া সুনির্দিষ্ট অভিযোগ না থাকায় জামিনযোগ্য বিষয়। জবাবে আদালত বলেন, আমরা কোন বিভেদ করছি না। দুই সপ্তাহের রুল জারি করছি। তখন ১৮ দলীয় জোটের নেতাদের আপত্তির মুখে আদালত এক সপ্তাহের জন্য রুল জারির কথা বলেন। এরপর মওদুদ আহমদ রুহুল কুদ্দুস তালুকদারের বিষয়টি তুলে ধরে বলেন, ঘটনার দিন তিনি নাটোরে ছিলেন। সেই ভদ্রলোককে কিভাবে এফআইআরে ঢুকানো হল। তিনি তো ঢাকাতেই ছিলেন না। তিনি নাটোরের আদালতে সেদিন জামিনের জন্য উপস্থিত ছিলেন। এটা আদালতের নথিতে আছে। আদালতের নথিভুক্ত বিষয়। তখন নাটোরের আদালতের ওই কাগজপত্র তিনি আদালতকে দেখান। এ সময় আদালত সরকার পক্ষের আইনজীবীর কাছে বিষয়টি জানতে চাইলে অতিরিক্ত অ্যাটর্নি জেনারেল এমকে রহমান বলেন, এটা তো রেকর্ডে দেখা যাচ্ছে। তিনি ওই আদালতে ছিলেন। কিন্তু কিভাবে ঘটেছে, সেটা দেখতে হবে। এরপর মওদুদ আহমদ শফিউল আলম প্রধানের ব্যাপারে বলেন, তিনি ঘটনার দিন পঞ্চগড়ে ছিলেন। জনসভা করেছেন। পুলিশের সঙ্গে তার ও নেতাকর্মীর মারামারি হয়েছে। এই যে পত্রিকায় তার ছবিসহ রিপোর্ট এসেছে।
শুনানিতে নেতাদের পক্ষে আরও ছিলেন অ্যাডভোকেট খন্দকার মাহবুব হোসেন, নিতাই রায় চৌধুরী, মীর মোহাম্মদ নাসির উদ্দিন, রফিকুল ইসলাম মিয়া, বদরুদ্দোজা বাদল, রুহুল কুদ্দুস কাজল, সগীর হোসেন লিওন প্রমুখ। এছাড়া আদালতে উপস্থিত ছিলেন গোলাম মোহাম্মদ চৌধুরী আলাল, কায়সার কামাল, নাসির উদ্দিন আহম্মেদ অসীম. ব্যারিস্টার রাগীব-রউফ চৌধুরী, এহসানুর রহমান, মীর্জা আল মাহমুদ, শেখ মোহাম্মদ আলী, সালমা সুলতানা সুমা প্রমুখ।
খোকার বিষয়ে সিদ্ধান্ত ২৮ মে
এদিকে বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান সাদেক হোসেন খোকার আইনজীবী সুপ্রিমকোর্ট আইনজীবী সমিতির সভাপতি জয়নুল আবেদীন তার পক্ষে জামিন আবেদন উপস্থাপন করেন। অন্য আসামিদের সঙ্গে অতিরিক্ত যুক্তি হিসেবে স্বাস্থ্যগত বিষয়টি উপস্থাপন করে বলেন, তিনি মারাত্মক অসুস্থ। এই গ্রাউন্ড বিবেচনায় নিয়ে তাকে জামিন দেয়া হোক। এরপর তিনি পত্রিকার একটি প্রতিবেদন উপস্থাপন করেন। আদালত বলেন, পত্রিকার প্রতিবেদনে হবে না। মেডিকেল সার্টিফিকেট আছে কি-না, থাকলে দেন। জয়নুল মেডিকেল সার্টিফিকেট দিলে আদালত বলেন এফিডেভিট করে দিতে হবে। ২৮ মে তা দেয়ার কথা বলে সময় নেন জয়নুল। আদালত বেলা ২টায় শুনানির সময় নির্ধারণ করে। ১৮ দলীয় জোটের শরিক দল প্রগতিশীল গণতান্ত্রিক পার্টির চেয়ারম্যান শেখ শওকত হোসেন নিলু বিএনপি ও অন্য শরিকদের সঙ্গে কারাগারে গেলেও তার পক্ষে কোন আবেদন করা হয়নি।