ঢাকা টাইমস্ ডেস্ক ॥ দেশের বন্যা পরিস্থিতি ক্রমেই অবনতির দিকে যাচ্ছে। প্রধান প্রধান নদ-নদীর পানি বিপদ সীমার উপর দিয়ে প্রভাহিত হচ্ছে। এদিকে পাহাড় ধস, দেয়াল ধস, পাহাড়ি ঢল, ছিঁড়ে পড়া বিদ্যুতের তারে স্পৃষ্ট হয়ে এবং বজ পাতে বান্দরবান, কক্সবাজার ও চট্টগ্রামে নারী, শিশু, বৃদ্ধসহ ১১০ জন নিহত হয়েছে বলে খবর পাওয়া গেছে।
খবর পাওয়া গেছে, ইতিমধ্যে বান্দরবানে ৩৮, কক্সবাজারে ৩৯ ও চট্টগ্রামে নিহতের সংখ্যা ৩৩ জন। আহত হয়েছেন আরও চার শতাধিক। এছাড়াও অন্তত ৪০ জন নিখোঁজ রয়েছেন। আশংকা করা হচ্ছে হতাহতের এ সংখ্যা আরও বাড়তে পারে। এছাড়াও অসংখ্য গবাদিপশু ও ঘরবাড়ি চাপা পড়েছে। আশ্রয়হীন হয়ে পড়েছে আড়াই হাজারের বেশি মানুষ। তবে ত্রাণ ও দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা মন্ত্রণালয় বুধবার বিকাল পর্যন্ত ৯১ জনের মৃত্যুর কথা স্বীকার করেছে। জেলায় প্রাণহানির ঘটনায় এদিন জাতীয় সংসদে শোক প্রস্তাব গ্রহণ করা হয়।
এদিকে গত তিন দিন ধরে বিমান ও ট্রেন বন্ধ থাকায় চট্টগ্রাম ও সিলেটের সঙ্গে রাজধানী ঢাকার যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন রয়েছে। বিমানের রানওয়েতে পানি জমার কারণে বিমান উঠা-নামা বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। অপরদিকে রেলওয়ের একটি সেতু বন্যার পানির তোড়ে বিধ্বস্ত হওয়ায় ট্রেন চলাচল বন্ধ হয়ে গেছে। গতকাল ২৭ জুন যোগাযোগ ও রেলমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের বিধ্বস্ত সেতু এলাকা পরিদর্শন করে যত দ্রুত সম্ভব মেরামতের নির্দেশ দেন। মন্ত্রী বলেন, আপাতত সীতাকুণ্ড-ঢাকা ট্রেন চলাচল স্বাভাবিক রাখা হবে। সেতু মেরামতের পুরো পুরোপুরিভাবে ট্রেন চলাচল শুরু হবে। এই সেতু নির্মাণে সেনাবাহিনীও রেলওয়ের সঙ্গে যৌথভাবে কাজ করছে।
চট্টগ্রাম পরিস্থিতি ভয়াবহ
২৬ জুন রাত থেকে ২৭ জুন বিকাল পর্যন্ত মহানগরীর ছয় স্থানে পাহাড় ধসের ঘটনায় ২৩ জনের লাশ উদ্ধার করা হয়। এর মধ্যে উত্তর পাহাড়তলী ওয়ার্ডের জালালাবাদ এলাকায় আঁধারমানিক পাহাড় ধসে নিহত হয় একই পরিবারের ৫ জন। এর আগে ২৬ জুন রাতে প্রথম পাহাড় ধসের ঘটনা ঘটে নগরীর আকবর শাহ মাজার এলাকায় ইয়াছিন কলোনিতে। টানা প্রবল বর্ষণে নরম হয়ে যাওয়া পাহাড় ধসে পড়ে পাহাড়ের পাদদেশে থাকা ৩০টি ঘরের ওপর। খবর পেয়ে দমকল বাহিনীর কর্মীরা ঘটনাস্থলে গিয়ে ৬ জনের লাশ উদ্ধার করে। সেখান থেকে উদ্ধার আহত দু’জনকে চমেক হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। ২৬ জুন রাত সাড়ে ১০টার দিকে সেনাবাহিনীর একটি দলও এখানে উদ্ধার অভিযানে যোগ দেয়। এ রিপোর্ট লেখা পর্যন্ত সেখানে উদ্ধার অভিযান চলছিল। নগরীর খুলশী থানার বিশ্বকলোনি জয়ন্তিকা আবাসিক এলাকার পাশে হারবাতলী পাহাড় ধসে পাঁচজন নিহত হয়।
চট্টগ্রাম ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্সের বিভাগীয় উপ-পরিচালক রুহুল আমিন জানান, নগরীর ছয়টি স্পট থেকে ২০ জনের লাশ উদ্ধার হয়েছে। এছাড়াও ২৭ জুন বিকালে দুটি স্থানে উদ্ধার তৎপরতা চলছিল। সেখানে আরও কয়েকজন চাপা পড়ে আছে বলে স্থানীয়রা জানিয়েছেন। তিনি জানান, পাহাড়ের বিরাট অংশ ধসে পড়ায় পাঁচ থেকে ছয় ফুট মাটি সরিয়ে লাশ উদ্ধার করতে হয়েছে। ৬০ জন দমকল কর্মী ও ৪০ জন স্বেচ্ছাসেবক ছাড়াও পুলিশ, সেনাবাহিনী এবং স্থানীয় লোকজন উদ্ধার কাজে অংশ নেয়। ফায়ার সার্ভিসের পানি দিয়ে মাটি সরিয়ে লাশ উদ্ধার করা হয়। রাতে সিটি মেয়র এম মনজুর আলম, পুলিশ কমিশনার শফিকুল ইসলাম ও জেলা প্রশাসক ফয়েজ আহমদ ঘটনাস্থলে গিয়ে উদ্ধার তৎপরতা পরিদর্শন করেন। মেয়র এম মনজুর আলম জানান, পাহাড়ের পাদদেশে ঝুঁকি নিয়ে বসবাসরতদের সরে যেতে বারবার মাইকিং করা হয়েছে। তারপরও তারা না সরায় এ মর্মান্তিক প্রাণহানির ঘটনা ঘটেছে।
এদিকে নগরীর লালখান বাজার বাঘঘোনায় ধসেপড়া দেয়াল চাপায় শরীফ (১১) নামের এক শিশু মারা গেছে। পাঁচলাইশের সুগন্ধা আবাসিক এলাকায় ছিঁড়ে পড়া বিদ্যুতের তারে স্পৃষ্ট হয়ে রশিদুল (১৯) নামে একজন, বন্দর থানায় মাইলের মাথা এলাকায় নিজ বাড়িতে বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হয়ে তপু আহমেদ (৩৫) নামে একজন নিহত হয়েছে।
বাঁশখালীতে পাহাড় ধসে মঙ্গলবার সন্ধ্যায় উপজেলার শীলকূপ ইউনিয়নের আদর্শ গ্রামে একই পরিবারের ৩ জন ও কালীপুরের পালে গ্রামে একজন এবং সরল ইউনিয়নে গণ্ডামারা সীমান্তে বজ্রপাতে একজন নিহত হয়েছে।
এছাড়া সহস্রাধিক কাঁচা ঘরবাড়ি বিধ্বস্ত হওয়ার পাশাপাশি বন্যা আর পাহাড়ি ঢলে অর্ধশত কোটি টাকার ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। ভেসে গেছে লাখ লাখ টাকার মাছ। টানা বর্ষণে চট্টগ্রামের সঙ্গে বাঁশখালীর সড়ক যোগাযোগ বন্ধ হয়ে গেছে। বিদ্যুৎ সংযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ায় রোববার রাত থেকে বুধবার পর্যন্ত পুরো বাঁশখালী ছিল অন্ধকারে। উপকূলীয় ৫ ইউনিয়নে বেড়িবাঁধ ভেঙে লোনা পানি প্রবেশ করে সেখানকার ৬০ হাজার মানুষ পানিবন্দি হয়ে মানবেতর জীবন যাপন করছে। বাঁশখালী উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান আলমগীর কবির চৌধুরী, উপজেলা নির্বাহী অফিসার সাব্বির ইকবালসহ প্রশাসনের কর্মকর্তারা ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেছেন। এছাড়াও সীতাকুণ্ড ও হাটহাজারীতেও বহু নিহত ও আহত হওয়ার খবর পাওয়া গেছে। এসব অঞ্চলে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে।
বান্দরবানে বহু নিহত
প্রবল বর্ষণ, বজ পাত ও ভূমিকম্পের কারণে মঙ্গলবার শেষ রাতে স্মরণকালের ভয়াবহ পাহাড় ধসে জেলার লামা উপজেলার ফাইতং এলাকায় একটি পরিবারের ১০ জনসহ পাঁচ পরিবারের ২৫ জন এবং রূপসীপাড়ায় একই পরিবারের ৩ জন নিহত হয়েছে। জেলা প্রশাসন, উপজেলা প্রশাসন এবং জনপ্রতিনিধি সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে।
নাইক্ষ্যংছড়ি উপজেলার রেজু এলাকায় পাহাড় ধসে নিহত হয় একই পরিবারের ৩ জন। নাইক্ষ্যংছড়ি উপজেলা সদরে আরও ১ জন মারা গেছে। তাৎক্ষণিকভাবে তাদের নাম জানা যায়নি। এদিকে, দক্ষিণ বাইশারী এলাকায় পাহাড়ি ঢলের পানিতে ডুবে নিহত হয়েছেন একই পরিবারের ৬ জন।
লামা ও নাইক্ষ্যংছড়ি উপজেলার নানা স্থানে পাহাড় ধসে ও বানের পানিতে ডুবে আহত হয়েছে আরও শতাধিক ব্যক্তি। কমপক্ষে ৩ হাজার মাটির ঘর ও বেড়ার ঘর বিধ্বস্ত হয়েছে। গবাদিপশু মারা গেছে প্রায় ৫ হাজার। জেলা শহরে ১৯টি বন্যা আশ্রয় কেন্দ্রে প্রায় ৪ হাজার বন্যার্ত আশ্রয় নিয়েছেন। সেনা কমান্ডার ব্রিগেডিয়ার জেনারেল এম শামস উল হুদা, জেলা প্রশাসক কেএম তারিকুল ইসলাম এবং বান্দরবান পৌর মেয়র এম জাবেদ রেজা শহরের বন্যার্ত লোকের মাঝে বুধবার দুপুরে রান্না করা খাবার বিতরণ করেন ।
কক্সবাজারে নিহত ৩৯ জন
পাহাড় ধস, দেয়াল চাপা, বজ্রপাত এবং ঢলের পানিতে ভেসে গিয়ে কক্সবাজারে ৩৯ জনের মৃত্যু হয়েছে। এর মধ্যে উখিয়ায় ১০, মহেশখালীতে ৫, রামুতে ৭, কক্সবাজার সদরে ৩, পেকুয়ায় ৩, চকরিয়ায় ৮ ও কুতুবদিয়ার ২ জনের মৃত্যুর খবর নিশ্চিত করেছে জেলা প্রশাসন। পাহাড় ধসে ২৪, বজ পাতে ৫, দেয়াল চাপায় ৩ এবং পানিতে ডুবে মারা গেছে ৬ জন। নিখোঁজ রয়েছে কমপক্ষে ২০ জন। কক্সবাজারের জেলা প্রশাসক মোঃ জয়নুল বারী বুধবার ৩৯ জনের মৃত্যুর সত্যতা নিশ্চিত করেছেন। জেলার নিম্নাঞ্চলে ২ লক্ষাধিক মানুষ এখনও পানিবন্দি অবস্থায় রয়েছে। কক্সবাজার-চট্টগ্রাম, কক্সবাজার-টেকনাফ সড়ক বিধ্বস্ত হয়ে যাওয়ায় কক্সবাজারের সঙ্গে সারাদেশের যোগাযোগ বন্ধ রয়েছে। এছাড়া সাগর উত্তাল থাকায় সব ধরনের নৌচলাচল বন্ধ রয়েছে। কক্সবাজার ও চট্টগ্রাম সমুদ্র বন্দরে ৩ নং সতর্ক সংকেত বলবৎ রয়েছে। জেলা প্রশাসক মোঃ জয়নুল বারী বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত নিম্নাঞ্চল ও পাহাড় ধসে হতাহতদের ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেছেন। বন্যা পরিস্থিতি মোকাবেলায় নিজ নিজ উপজেলা চেয়ারম্যান ও নির্বাহী কর্মকর্তার নেতৃত্বে উপজেলা পরিষদ জেলা প্রশাসনের কন্ট্রোল রুমে প্রতি ঘণ্টায় বন্যা পরিস্থিতি ও ক্ষয়ক্ষতির রিপোর্ট প্রেরণের জন্য নির্দেশ দেয়া হয়েছে।
ত্রাণ ও দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা মন্ত্রণালয়ের যা বলেছে
মন্ত্রণালয়ের সচিব আসলাম আলম বুধবার সচিবালয়ে নিজের দফতরে সাংবাদিকদের বলেন, বেলা দেড়টা পর্যন্ত আমরা ৯১ জনের মৃত্যুর খবর পেয়েছি। উদ্ধার তৎপরতা চলছে। দুর্যোগকালীন স্বেচ্ছাসেবক, ফায়ার ব্রিগেড ও সেনাবাহিনীর কর্মীরা উদ্ধার তৎপরতা চালিয়ে যাচ্ছেন। বর্ষণজনিত দুর্যোগে চট্টগ্রাম বিভাগে নিহতের সংখ্যা আরও বাড়তে পারে বলে আশংকা প্রকাশ করেন তিনি।
সচিব বলেন, নিহতদের প্রত্যেকের পরিবারকে সরকারিভাবে ২০ হাজার টাকা দেয়ার ব্যবস্থা হয়েছে। এছাড়া ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারের সদস্যদের থাকা ও খাওয়ার ব্যবস্থা করা হচ্ছে। দ্রুত এ বিপর্যয় কাটিয়ে ওঠার আশা প্রকাশ করে তিনি বলেন, বর্তমানে পরিস্থিতি উন্নতির দিকে। আর বৃষ্টি না হলে সমস্যা হবে না। আসলাম আলম আরও বলেন, দুর্যোগের মধ্যে খাদ্য সংকট এড়াতে ওইসব এলাকায় ৫০ টন চাল ও ৬৬ লাখ টাকা বরাদ্দ দেয়া হয়েছে। এছাড়া প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবেলায় প্রত্যেক জেলার জন্য দুই লাখ টাকা করে দেয়া হয়েছে। সচিব জানান, স্থানীয় প্রশাসনকে প্রয়োজনে জরুরিভাবে খাদ্য কিনে পরিস্থিতি সামাল দিতেও নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুযায়ী, কয়েক দিনের টানা বর্ষণ ও পাহাড়ি ঢলে চট্টগ্রাম, বান্দরবান ও কক্সবাজারে দুই হাজার ৪১৩ জন আশ্রয়হীন হয়ে পড়েছে। তাদের ১৯টি আশ্রয় কেন্দ্রে আশ্রয় দেয়া হয়েছে।
হতাহতের ঘটনায় জাতীয় সংসদে শোক প্রস্তাব
প্রাকৃতিক দুর্যোগে চট্টগ্রাম-কক্সবাজার অঞ্চলে নিহতদের স্মরণে গতকাল ২৭ জুন জাতীয় সংসদে শোক প্রস্তাব গ্রহণ করা হয়েছে। সংসদে ২০১২-১৩ সালের বাজেট পাশের অধিবেশনে স্পিকার অ্যাডভোকেট আবদুল হামিদ এই শোক প্রস্তাব উত্থাপন করেন। স্পিকার বলেন, প্রাকৃতিক দুর্যোগে চট্টগ্রাম-কক্সবাজার ও আশপাশের এলাকায় এ পর্যন্ত ৯৪ জনের প্রাণহানি ঘটেছে। জাতীয় সংসদ এ বিষয়ে গভীর দুঃখ প্রকাশ করছে। নিহতদের আত্মার মাগফেরাত ও আহতদের সুস্থতা কামনা করছে। এ দুর্যোগ মোকাবেলায় সরকার সার্বিক প্রস্তুতি নিয়েছে। সেনাবাহিনী ও স্থানীয় সরকার সেখানে কাজ করছে। দ্রুত ওই এলাকার জনগণের দুর্ভোগ লাঘব হবে বলে তিনি আশা প্রকাশ করেন। পরে শোক প্রস্তাবটি সর্বসম্মতিতে গৃহীত হয়।
এদিকে আওহাওয়া অধিদপ্তর জানিয়েছে, পদ্মা, মেঘনা, যমুনাসহ দেশের প্রধান প্রধান নদ-নদীর পানি বর্তমানে বিপদ সীমার উপর দিয়ে প্রভাহিত হচ্ছে। পরিস্থিতির আরও অবনতি ঘটার সম্ভাবনা রয়েছে।