দি ঢাকা টাইমস্ ডেস্ক ॥ আবারও মিয়ানমারে রোহিঙ্গা ইস্যু নিয়ে উত্তপ্ত পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে। আবারও মুসলমানদের উপর হামলার ঘটনা ঘটেছে। বারংবার অভিযোগ করা হয় সশস্ত্র রোহিঙ্গা মুসলিম গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে। তবে এই সশস্ত্র রোহিঙ্গা মুসলিমদের নেপথ্যে আসলে কারা কাজ করছে? সেটি সকলের মনেই প্রশ্ন আকারে দেখা দিয়েছে।
গত শুক্রবার যে সশস্ত্র হামলার পর মিয়ানমারের রাখাইন প্রদেশ আবার অশান্ত হয়ে ওঠে তার জন্য মিয়ানমারের সরকার বার বার দোষারোপ করছে ‘আরাকান রোহিঙ্গা স্যালভেশন আর্মি’ নামে একটি সংগঠনকে।
গত বছরের অক্টোবরেও রাখাইনে পুলিশ ফাঁড়ির ওপর হামলার ঘটনার জন্য দায়ী করা হচ্ছিল এই সশস্ত্র গোষ্ঠীকেই।
রোহিঙ্গাদের মধ্যে এরকম সশস্ত্র গোষ্ঠীর তৎপরতার কথা আগেও শোনা গেছে, তবে এই সংগঠনটির নাম এর আগে কেও শোনেনি।
মিয়ানমারের সরকারের দিক হতে রোহিঙ্গা মুসলিমরা ধারাবাহিকভাবে যে বৈষম্য-অত্যাচার-নিপীড়নের শিকার হচ্ছেন, এর কারণে তাদের অনেকে কি এখন সশস্ত্র জঙ্গী মতাদর্শের দিকে ঝুঁকে পড়ছে? অনেকেই সে প্রশ্নও তুলেছেন।
আরাকান রোহিঙ্গা স্যালভেশন আর্মি আগে ইংরেজীতে এদের বলা হতো ‘ফেইথ মুভমেন্ট’। এই নামেই তারা তাদের তৎপরতা চালাতো। স্থানীয়ভাবে এটি পরিচিত ছিল ‘হারাকাহ আল ইয়াকিন’ নামেই।
মিয়ানমারের সরকার ইতিমধ্যে রোহিঙ্গা স্যালভেশন আর্মিকে একটি সন্ত্রাসবাদী গোষ্ঠী বলে ঘোষণাও করেছে। মিয়ানমার বলছে যে, এই গ্রুপটির নেতৃত্বে রয়েছে রোহিঙ্গা জিহাদীরা, যারা বিদেশে প্রশিক্ষণ নিয়েছে। তবে সংগঠনটি কতো বড়, এদের নেটওয়ার্কবা কতোটা বিস্তৃত, তার কোনো পরিস্কার ধারণা তাদের কাছেও একেবারেই নেই।
মিয়ানমারের কর্মকর্তারা ধারণা করছেন, এই গোষ্ঠীর নেতৃত্বে রয়েছে ‘আতাউল্লাহ’ নামে একজন রোহিঙ্গা। তার জন্ম করাচীতে, তিনি বেড়ে উঠেছেন সৌদি আরবে।
আন্তর্জাতিক গবেষণা সংস্থা ‘ইন্টারন্যাশনাল ক্রাইসিস গ্রুপ’ তাদের এক রিপোর্টে বলেছে, সংগঠনটি মূলত গড়ে উঠেছে সৌদি আরবে চলে যাওয়া রোহিঙ্গাদের নিয়ে।
সংবাদ মাধ্যমের খবরে বলা হয়েছে, মক্কায় থাকে এমন ২০ জন নেতৃস্থানীয় রোহিঙ্গা এই সংগঠনটি গড়ে তুলেছে। বাংলাদেশ, পাকিস্তান ও ভারতে এদের সংযোগ রয়েছে।
সংগঠনটির নেতা আতাউল্লাহ ‘আবু আমর জুনুনি’ নামেও অধিক পরিচিত। আতাউল্লাহর বাবা রাখাইন হতে পাকিস্তানের করাচীতে চলে যান। সেখানেই আতাউল্লাহর জন্ম হয়। তবে তিনি বেড়ে উঠেছেন মক্কায়। সেখানে মাদ্রাসায় পড়াশোনা করেছেন তিনি। ইউটিউবে তার একটি ভিডিও হতে ধারণা করা যায়, রাখাইনের রোহিঙ্গারা যে ভাষায় কথা বলে সেটি ও আরবী, এই দুই ভাষাই তিনি অনর্গল কথা বলতে পারেন। ২০১২ সালে আতাউল্লাহ সৌদি আরব হতে অদৃশ্য হয়ে যান। এরপর সম্প্রতি আরাকানে নতুন করে সহিংসতা শুরু হওয়ার পর তার নাম উঠে আসে।
আরাকানে যারা এই সংগঠনটির সঙ্গে যুক্ত রয়েছেন, তাদের আধুনিক গেরিলা যুদ্ধের প্রশিক্ষণ রয়েছে বলে মনে করা হয়। স্থানীয় রোহিঙ্গাদের মধ্যে এই সংগঠনটির প্রতি সমর্থন ও সহানুভূতি রয়েছে।
সংবাদ মাধ্যমের খবরে জানা যায়, আরাকান রোহিঙ্গা স্যালভেশন আর্মি বা ‘আরসা’ গত মার্চ মাসে এক বিবৃতিতে একেবারে খোলাখুলিই জানিয়েছে যে, তারা মিয়ানমারে রোহিঙ্গা মুসলিমদের অধিকার রক্ষার জন্য কাজ করছে। তাদের ‘আত্মরক্ষা-মূলক’ হামলার মূল টার্গেট হলো মিয়ানমারের ‘নিপীড়নকারী শাসকগোষ্ঠী।’
আরসার প্রধানের দাবি হচ্ছে, মিয়ানমারে রোহিঙ্গা মুসলিমদের নাগরিকত্ব ও সমান মর্যাদা দিতে হবে। ‘আরসা’ তাদের ওই বিবৃতিতে আরও বলেছে যে, তারা বেসামরিক নাগরিকদের বিরুদ্ধে কোনো ধরণের সন্ত্রাসবাদী কাজে লিপ্ত হবে না। তাদের অধিকার আদায়ের জন্য তারা সন্ত্রাসবাদে বিশ্বাসী নয়। বিশ্বের কোনো সন্ত্রাসবাদী গোষ্ঠীর সঙ্গেও তাদের কোনো রকম সম্পর্ক নেই। এমনকি তারা রাখাইনের বিভিন্ন ধর্মের এবং জাতির মানুষকে ও তাদের ধর্মীয় উপাসনার স্থানের নিরাপত্তার নিশ্চয়তাও দিচ্ছে বলে উল্লেখ করা হয়েছে।
লন্ডন ভিত্তিক একটি রোহিঙ্গা সংগঠন আরাকান ন্যাশনাল রোহিঙ্গা অর্গেনাইজেশনের চেয়ারম্যান নুরুল ইসলাম বিবিসি বাংলাকে বলেছেন, গত অক্টোবরে সর্বপ্রথম রোহিঙ্গা স্যালভেশন আর্মির কথা সবাই জানতে পারে। তারা তখন একটি পুলিশ ফাঁড়ির ওপর হামলা চালায়।
নুরুল ইসলামের মতে, যারা এই সংগঠনে যুক্ত রয়েছে, তারা মরিয়া হয়ে বা বাধ্য হয়ে এরকম একটা পথ বেছে নিয়েছে।
“মাঝে মধ্যে ইন্টারনেটে এদের বক্তব্য-বিবৃতি দেখা যায়। এরা আরাকানে রোহিঙ্গাদের অধিকার ও স্বাধীনতার জন্য লড়ছে।”
নুরুল ইসলাম বলেছেন “এরা জঙ্গীও নয়, কোনেসা আন্তর্জাতিক জঙ্গী গোষ্ঠীর সঙ্গেও এদের কোনো সম্পর্ক নেই। এরা আরাকানে বেড়ে উঠা একটি গোষ্ঠীমাত্র, যারা রোহিঙ্গাদের জন্য লড়ছে বলে দাবি করে আসছে।”
এ বিষয়ে ইন্টারন্যাশনাল ক্রাইসিস গ্রুপ বলেছে, রোহিঙ্গাদের মধ্যে সংগঠিত সশস্ত্র গোষ্ঠীর উত্থান পুরো আরাকানের পরিস্থিতিকে আরও জটিলতর করে তুলতে পারে। মিয়ানমারের সরকার যদি রাজনৈতিক সমাধানের পরিবর্তে নির্বিচার সামরিক বল প্রয়োগের মাধ্যমে এদের দমন করতে চাই, তাতে বরং সেখানে চক্রাকারে সহিংসতার মাত্রা আরও বেড়ে যাবে। তাই অনেক বুঝে শুনেই চলতে হবে মিয়ানমার সরকারকে।
উল্লেখ্য, মিয়ানমার সরকার রোহিঙ্গা মুসলমানদের উপর একের পর এক হামলা চালাচ্ছে। নিরীহ শিশু ও মহিলারা তাদের হামলার শিকার হচ্ছেন। মহিলাদের ধর্ষণ ও বাড়ি-ঘর পুড়িয়ে দেওয়ার মতো ঘটনা ঘটাচ্ছে মিয়ানমার সরকার। মিয়ানমারের এই অমানবিক কার্যক্রমে জাতিসংঘসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশ নিন্দা জানিয়ে অবিলম্বে এই নির্যাতন বন্ধের আহ্বান জানিয়েছে।