এম. এইচ. সোহেল ॥ আর কতো রাজীবকে এভাবে অকালে প্রাণ দিতে হবে? এই প্রশ্ন যদি জাতির কাছে করা যায় তার কোনো উত্তর খুঁজে পাওয়া যাবে না।
দিনের পর দিন, মাসের পর মাস, বছরের পর বছর ঠিক এভাবেই চলতে থাকবে। কোনো প্রতিকার নেই এহেন কর্মকাণ্ডের। কারণ গাড়ির স্টিয়ারিং ধরে যা খুশি তাই করা যায়। যেভাবে খুশি সেভাবেই চালানো হয়। তাতে মানুষের প্রাণ গেলেও যেনো চালকদের কোনো মাথা ব্যথা থাকে না। রাজিবের ক্ষেত্রে যে ঘটনা ঘটলো সেটি সারা বাংলাদেশে প্রতিনিয়তই ঘটছে। কিন্তু এর যেনো কোনো প্রতিকার নেই। যদি সরকার চালকদের বিরুদ্ধে কঠোর কোনো আইন করতে যায়, বা কোনো কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করতে যায় তাহলে শুরু হয়ে যায় পরিবহন ধর্মঘট!
আর এভাবেই বছরের পর বছর চলছে মহাসড়কগুলোতে চালকদের রাম রাজত্ব। কেও কিছু বলতে পারবে না। এই অবস্থা চলতে পারে না। চালকদের বেপরোয়া মনোভাবের কারণেই বেশির ভাগ দুর্ঘটনাগুলো ঘটে থাকে।
৩ এপ্রিল দুই বাসের রেষারেষির (প্রতিযোগিতা) মধ্যে পড়ে ঢাকার সরকারি তিতুমীর কলেজের স্নাতকের (বাণিজ্য) দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র রাজীব হোসেন (২১) এর হাত কাটা পড়ে। ১৩ দিন ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে মৃত্যুর সঙ্গে পাঞ্জা লড়াই করে হার মানেন রাজিব। গত সোমবার দিবাগত রাতে না–ফেরার দেশে চলে যান রাজীব।
রাজীবের এভাবে চলা যাওয়া কেওই যেনো মানতে পারছেন না। এই ঘটনার রেষ কাটতে না কাটতেই গোপালগঞ্জে বাসের পাশ ঘেঁষে একটি ট্রাক যাওয়ার সময় হাত হারিয়েছেন খালিদ হাসান হৃদয় (২০) নামে অপর এক তরুণ। হৃদয়ের শরীর হতে হাতটি বিচ্ছিন্ন হয়ে সড়কে পড়ে যায়। মঙ্গলবার সকাল সাড়ে ১০টার দিকে গোপালগঞ্জ সদরের পাশে বেতগ্রাম বাসস্ট্যান্ড এলাকায় ঘটে এই ঘটনা।
এভাবে একের পর এক ঘটছে দুর্ঘটনা। আর এগুলোকে পুরোপুরি দুর্ঘটনা বলা যায় না। কারণ বেশিরভাগ ঘটনাগুলোই চালকদের খামখেয়ালি বা প্রতিযোগিতা করার জন্যই দায়ি।
# চালকদের ড্রাইভিং লাইসেন্সের ক্ষেত্রে আরও কড়াকড়ি করতে হবে। যারা লাইসেন্স দিচ্ছেন অর্থাৎ যে সব কর্মকর্তা এর সঙ্গে সংশ্লিষ্ট তাদেরকে জবাবদিহিতার মধ্যে আনতে হবে। যাতে অযোগ্য ব্যক্তি টাকার মাধ্যমে লাইসেন্স পেয়ে না যায়।
# গাড়ির মালিকদের চালক নিয়োগের সময় লাইসেন্স পর্যবেক্ষণ এবং অভিজ্ঞতা সম্পর্কে নিশ্চিত হতে হবে।
# সড়ক বা মহাসড়কে চলাচলের সময় চালকরা যাতে কখনও প্রতিযোগিতায় না নামেন সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে।
সড়ক দুর্ঘটনার জন্য দায়ি আরও কয়েকটি কারণ পর্যবেক্ষণ করতে গেলে আরও যেগুলো পাওয়া যাবে সেগুলো হলো:
বাঁকা রাস্তা ও ডিভাইডার না থাকা :
দেশের আন্তজেলা মহাসড়কগুলোর ক্ষেত্রে অধিকাংশ সড়ক দুর্ঘটনা ঘটে থাকে যেখানে যানবাহন খুব দ্রুতবেগে চলাচল করে থাকে সে কারণে। এসব সড়কগুলোতে মুখোমুখি অবস্থানে যানবাহন চলাচল করলেও সড়কগুলো প্রশস্ত নয় এবং কোনো ডিভাইডারও নেই। যে কারণে যানবাহনগুলো যখন পাশাপাশি চলে আসে তখন তাদের মধ্যে নিরাপদ দুরত্ব না থাকায় মাঝে মধ্যেই মুখোমুখি সংঘর্ষও ঘটে। নিরাপদ দুরত্ব রাখতে হলে রাস্তা ছেড়ে যানবাহনকে নিচে নেমে আসতে হয়। যে কারণে নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে খাদে পড়ে যায় যানবাহন।
ত্রুটিপূর্ণ ও পুরোনো যানবাহন :
ত্রুটিপূর্ণ ও পুরোনো যানবাহনগুলো সরিয়ে নিতে সরকার একটি পদক্ষেপ নিয়েছিলো বছরখানেক পূর্বে। যে সব যানবাহনগুলো ২৫ বছরের পুরোনো, সেগুলো সরিয়ে নেওয়ার কথা ছিলো। তবে তা সরকার বাস্তবায়ন করেছে কি-না তা কখনও চোখে পড়েনি, যদি করেও থাকে তা নামকাওয়াস্তে করা হয়েছে। তবে ঢাকার বাইরে অসংখ্য পুরাতন ও ফিটনেসবিহীন গাড়ি চলছে যেগুলো দুর্ঘটনা ঘটানোর অন্যতম কারণ হিসেবে চিহ্নিত।
সংস্কারবিহীন ভাঙ্গা অযোগ্য সড়ক :
আমাদের দেশের অধিকাংশ সড়কের অবস্থা অত্যন্ত করুণ। মহাসড়কের রাস্তাগুলো হতে হবে যুগোপযোগী, টেকসই, ভালো কিংবা উন্নতমানের। যেনো সকলের ব্যবহার উপযোগী হয়। অথচ আমাদের দেশের রাস্তাঘাটগুলোর ক্ষেত্রে বেশির ভাগ দেখা যায়, রাস্তঘাটগুলো জোড়াতালি দিয়ে তৈরি করা হয়। তৈরি করার ৬ মাসের মধ্যেই ব্যবহারের অযোগ্য হয়ে পড়ে এমন অনেক রাস্তার নজির আমাদের কাছে আছে। যেকোনো ধরনের সড়ক নির্মাণে আমাদেরকে আরও অধিক যত্নবান হতে হবে। তাই সড়ক নির্মাণের ক্ষেত্রে সরকারের নজরদারি আরও বৃদ্ধি করা দরকার। তাছাড়া স্বজনপ্রীতি ও অনিয়ম কখনই যেনো গ্রহণযোগ্য না হয় সে দিকটাও খেয়াল রাখা দরকার।
চালকের দক্ষতা বৃদ্ধি ও প্রশিক্ষণ :
আমাদের দেশের বেশির ভাগ দুর্ঘটনার জন্য দায়ি থাকে চালকের অদক্ষতা বা খামখেয়ালীপনা। দুর্ঘটনার পরও এসব চালকদের বিরুদ্ধে আইনগত কোনো রকম ব্যবস্থা নেওয়া হয় না। আবার এও সত্য, অধিকাংশ চালকদের প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা দেওয়ার মতো অবকাঠামো সরকারের এখনও গড়ে ওঠেনি। সরকারের এই ব্যর্থতাকে কাটিয়ে উঠে প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা গ্রহণ করা জরুরি হয়ে পড়েছে।
ড্রাইভিং পেশা :
ড্রাইভিং পেশাটি আমাদের দেশে এখনও নিম্নমানের পেশা হিসেবেই বিবেচনা করা হয়ে থাকে। বিশেষ করে, বাস ও ট্রাক ড্রাইভাররা ২৪ ঘন্টার মধ্যে ১৬ হতে ১৮ ঘণ্টা বা কখনও কখনও তারও বেশি পরিশ্রম করেন। এতো দীর্ঘ সময় এরা পরিবার-পরিজন থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পথঘাটে থাকতে থাকতে তাদের মধ্যে এক ধরনের অস্থিরতার সৃষ্টি হয়। এতে করে তারা শারীরিক ও মানষিকভাবে বিপর্যস্ত হয়ে পড়েন। যে কারণে তারা তাদের পেশায় মনোনিবেশ করতে পারেন না। এটিও দুর্ঘটনার একটি বড় কারণ হিসেবে মনে করা হয়।
ট্রাফিক সিগনাল ব্যবস্থায় নতুনত্ব আনয়ন :
আমাদের দেশে এখনও অনেক কিছুই পুরাতন পদ্ধতি অনুসারে চলে আসছে। এর মধ্যে অন্যতম বিষয় হলো বাংলাদেশের ট্রাফিক সিগনাল ব্যবস্থা। এই ট্রাফিক সিগনালিং ব্যবস্থার আধুনিকায়ন করা জরুরি হয়ে পড়েছে। বর্তমানে সময়ের দাবি হয়ে দাঁড়িয়েছে গতি পরিমাপক, ওজন পরিমাপক, জিপিএস প্রযুক্তির মতো আধুনিক বিষয়গুলোর অন্তর্ভুক্তি।
যুগোপযোগী আইন প্রণয়ন ও প্রয়োগের ব্যবস্থা করা :
দেশের চলমান ট্রাফিক আইন সংশোধন এবং তার যথাযথ প্রয়োগ একান্ত জরুরি হয়ে পড়েছে। অবৈধ চালক, ফিটনেসহীন গাড়ি আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা আটক করেন তার অধিকাংশই অর্থের বিনিময়ে বৈধ হয়ে যায় কিংবা মামলা কাগজ কলমেই থাকে। এসবের সঠিক প্রয়োগ দরকার।
সবকিছু মিলিয়ে পরিবহন সেক্টরে যে অরাজকতা বর্তমানে বিদ্যমান সেগুলোর দিকে দৃষ্টি দেওয়া জরুরি হয়ে পড়েছে। সরকার যেমন কোটি কোটি টাকা ব্যয় করে সড়ক নির্মাণ, সেতু নির্মাণ করছেন সেই সঙ্গে সরকারের আরও একটি গুরু দায়িত্ব হলো পরিবহন সেক্টরের নৈরাজ্য দূর করা। সঠিক পদ্ধতির মধ্যে এনে পরিবহন খাতের উন্নতি না করতে পারলে আমার আপনারা সন্তানদের দিনের পর দিন এভাবেই চালকদের স্বেচ্ছাচারিতার বলি হতে হবে- যা দেশ ও জাতির জন্য কখনও মঙ্গল বয়ে আনবে না।