ঢাকা টাইমস্ ডেস্ক ॥ হূমায়ুন আহমেদকে ছাড়া এবার প্রথমবারের মতো ঈদ করতে হলো নিষাদ ও নিনিতকে। ফুলের মতো এই শিশু দুটি যেনো এক অসহায়ের মতো এবারের ঈদ উদযাপন করলো।
ঈদের দিন ছোট্ট নিষাদ ও নিনিত বাবার হাতের স্পর্শ পেয়ে জেগে উঠত। যেন ভোরের নরম আলোর স্পর্শে ফুটে উঠত দুটি ফুল। নিষাদ-নিনিত বিরক্ত হতো না। বাচ্চাদের নিজ হাতে গোসল করাতেন তিনি। বাবা-ছেলে গোসল করত একসঙ্গে। এত সকালে গোসলেও বাচ্চাদের যে কী আনন্দ! তোয়ালে দিয়ে গা মুছতে মুছতে হুমায়ূন আহমেদ ডাকতেন, কুসুম, কই তুমি আমাদের ফুটবল টিমের জার্সিগুলো দাও!
হুমায়ূন আহমেদ ও তাঁর দুই শিশুপুত্রের জন্য ঈদের পোশাক বের করে দিতেন স্ত্রী মেহের আফরোজ শাওন। পোশাকগুলো একই রঙের, একই ডিজাইনের। কারচুপি ও হাতের কাজ করা পাঞ্জাবি-পায়জামা। ফ্যাশন হাউস অন্যমেলা তাদের জন্য তৈরি করে দিত ঈদের বিশেষ পোশাক। রং ও নকশা একই বলে হুমায়ূন আহমেদ এটাকেই মজা করে বলতেন, ফুটবল টিমের জার্সি! ঈদের দিনগুলোর স্মৃতিচারণা করতে গিয়ে আপ্লুত হয়ে এসব কথা জানান হুমায়ূনপত্নী মেহের আফরোজ শাওন। বারবার তিনি উলেস্নখ করছিলেন বাবা-ছেলেদের একই পোশাকে নামাজ পড়ার অম্লান স্মৃতি।
স্মৃতিচারণা করে শাওন বলেন, নিনিত জন্মের পর প্রথম ঈদ পায় চার দিন বয়সে আর নিষাদ ৯ মাসে। যে সময় হাঁটতে শেখেনি, সে সময় থেকেই বাবার সঙ্গে ঈদের নামাজে যেত ওরা। প্রথম দিকে বাবা ছেলেদের কোলে নিয়ে নামাজে যেতেন। পরের দিকে ওরা হাঁটতে শিখলে বাবার আঙুল ধরে যেত ঈদগাহ মাঠে।
ধানমণ্ডির দখিন হাওয়ার ফ্ল্যাটে গিয়ে দেখা যায়, ঈদ উপলক্ষে এবারও নুহাশ, নিষাদ ও নিনিতের জন্য আনা হয়েছে একই রঙের, একই নকশার পোশাক। কিন্তু যিনি আনন্দের সঙ্গে একই রকমের পোশাক পরে ছেলেদের নিয়ে ঈদগাহে যেতেন, সেই তিনিই শুধু নেই!
শরতের শুভ্র আকাশে প্রতিবারের মতো এবারও উঠেছে ঈদের চাঁদ। কিন্তু সেই খুশি ও আনন্দের ছোঁয়া নেই এই পরিবারে। ছোট নিষাদ ও নিনিত এবারও পরবে রঙিন পোশাক, কিন্তু যাঁর আঙুল ধরে মাঠে যেত, বাবার সেই কোমল হাতের স্পর্শ, স্নেহের আদর এবার পাবে না ওরা।
ঈদের দিন খুব ভোরে ঘুম থেকে জেগে উঠতেন হুমায়ূন আহমেদ। বাইরে তখনো থাকত আবছা অন্ধকার। তিনি কিছুক্ষণ পায়চারি করতেন বারান্দায়। এরপর ফজরের নামাজ পড়ে ঘুম থেকে ওঠাতেন দুই শিশুপুত্র নিষাদ ও নিনিতকে।
শাওন জানান, এই ঈদে কে ওদের ঘুম ভাঙাবে, কে ওদের গোসল করাবে! কথাগুলো বলতে গিয়ে আনমনা হয়ে পড়েন তিনি। কণ্ঠ ধরে আসে। চোখের কোণে জমে অশ্রু। চোখ মুছতে মুছতে বললেন, নিনিতের যখন চার দিন বয়স তখনো ওর বাবার সঙ্গে মিল রেখে নিনিতের জন্য পোশাক তৈরি করা হয়। একই রঙের পাজামা-পাঞ্জাবি। কথা বলতে বলতে দীর্ঘশ্বাস ফেলছিলেন শাওন। পাশেই খেলনা গাড়ি নিয়ে খেলছে নিষাদ, নিনিত। শাওন বললেন, নিষাদ ওর বাবার সঙ্গে ঈদ পেয়েছে ১১টি, নিনিত পেয়েছে চারটি। প্রতি ঈদে হুমায়ূন আহমেদ বাচ্চাদের নিয়ে ছবি ওঠাতেন। পরনে থাকত এই রকম পোশাক।
সর্বশেষ তাদের নিয়ে ঈদ করেছেন গত কোরবানি ঈদ। তখন তাঁরা নিউ ইয়র্কে। সেখানেও তাঁদের জন্য দেশ থেকে পাঠানো হয় একই রকমের পাজামা-পাঞ্জাবি। সেবার কোরবানি ঈদের দিন তাঁদের বাসায় এসেছিলেন নোবেলজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূস।
শাওন বলেন, নামাজ পড়ে এসেই খাবারের টেবিলে বসতেন হুমায়ূন। খাবারের টেবিলে সেমাই, মিষ্টি আর পায়েশের পাশাপাশি জায়গা করে নিত পোলাও, মুরগির রোস্ট, গরুর মাংস, গরুর কলিজা। আর সাদা ভাতের সঙ্গে নানা পদের ভর্তা। সব রান্না আমিই করতাম। তিনি আমার রান্না খুব পছন্দ করতেন। পোলাও, রোস্ট, গরুর মাংস, গরুর কলিজা যা-ই রান্না করতাম তা-ই মজা করে খেতেন।
ঈদের দিন বিকেলে হুমায়ূন যেতেন পল্লবীতে ছোট ভাই আহসান হাবীবের বাসায়। সন্ধ্যায় যেতেন গুলশানে শাওনের মায়ের বাসায়। সেখানেই রাতে একসঙ্গে খেতেন, দেখতেন ঈদের নাটক। এরপর দখিন হাওয়ায় ফিরতেন রাতে।
ঈদের দিন মা আয়েশা ফয়েজের পা ছুঁয়ে দোয়া নিতেন হুমায়ূন। মা তাঁর প্রিয় সন্তানকে প্রাণভরে দোয়া করতেন। এবার আর সেই সন্তান ফিরবে না মায়ের কাছে।
ঈদের দিন সকালে নিষাদ-নিনিতের পরনে নীল রঙের পাঞ্জাবি ও সাদা চুরিদার পাজামা থাকলেও থাকেনি তাদের প্রিয় মানুষটি। তাদের বাবা হুমায়ূন আহমেদ চিরদিনের জন্য ঘুমিয়ে আছেন নুহাশ পল্লীর সেই লিচুতলায়।