মুহাম্মদ আলতাফ হোসেন ॥ বাংলাদেশের ইতিহাসের মহান দিন ২৬ মার্চ। আমাদের স্বাধীনতা দিবস। আজ মহান স্বাধীনতা দিবস। এই দিনে স্বাধীনতা নিয়ে সবচেয়ে সুন্দর, তাৎপর্যপূর্ণ ও সুদূরপ্রসারী কথা বলবেন রাজনীতিবিদ, দার্শনিক, কবি, সাংবাদিক এবং সর্বস্তরের মানুষ। সবাই মিলে স্বাধীনতার অর্থ, ব্যঞ্জনা ও ভাবকল্পকে বহুদূরগামী স্বপ্নের মতোন প্রসারিত করবেন মানুষের হৃদয়ে হৃদয়ে। স্বাধীনতাকে দিনযাপনের ভাবনায় আর ভবিষ্যতের সুখজাগানিয়া রোমাঞ্চের পথে একটি অদেখা নান্দনিক ভুবনের দিকে নিয়ে যাবেন। মানবাত্মার অতল গভীরে উড়ে উড়ে স্বাধীনতার অনিন্দ্য প্রভা ও দ্যোতনাকে কোকিলের সুর-ব্যঞ্জনায় নিত্য গুঞ্জরিত করবেন এক সুনিবিড় ভালবাসায়।
স্বাধীনতার দিক-নির্দেশনা দেন দার্শনিকেরা; সংগ্রাম করেন রাজনীতিবিদগণ। কিন্তু একে পত্র-পল্লবে সুসজ্জিত করেন, মানুষের তন্ত্রীতে গেঁথে দেন কবিগণ। ‘স্বাধীনতাহীনতায় কে বাঁচিতে চায়.., উচ্চারণটি তো একজন কবির পক্ষেই করা সম্ভব। স্বাধীনতা নিয়ে কাব্যকথা নির্মাণ করেননি-এমন কোনও কবিরই সন্ধান পাওয়া অসম্ভব। বাংলা, উর্দু, হিন্দি, ফারসি, ইংরেজি, স্পেনিশ, আরবি, ফরাসি-সকল ভাষার কবিরাই তাঁদের শ্রেষ্ঠ কবিতাটি রচনা করেছেন স্বাধীনতা আর মুক্তির আলোয় আলোয়। আর জনগণ সেই স্বাধীনতার স্পৃহায় মুক্তির সোপান গড়ে তোলেন।
তুরস্কের একজন কবি ছিলেন। নাম নাজিম হিকমত। রূপকথার মতোই জনপ্রিয় এই কবিকে দীর্ঘ ১৮ বছর কাটাতে হয়েছিল তাঁরই দেশের কারাগারে। সরকারের উদ্ভট আদেশে বাকী জীবনটাও তাঁকে কাটাতে হয় বিদেশে, নির্বাসনে। সে দেশের নৌসেনাদের বিদ্রোহে প্ররোচিত করার অভিযোগে নাজিমের ভাগ্যে জুটেছিল এই শাস্তি। এক যুদ্ধজাহাজে অবস্থিত তাঁর বিচার সভার বর্ণনা করতে করতে তিনি বলেছিলেন, জাহাজের ডেকে শৃংখলাবদ্ধ অবস্থায় তাঁকে দৌড়াতে হয়েছিল ততক্ষণ, যতক্ষণ না তিনি অসুস্থ হয়ে পড়েছিলেন। তারপর তাঁকে আবদ্ধ করে রাখা হয়েছিল পায়খানাঘরে। সেই ঘরের মলের স্তুপে তাঁর কোমর পর্যন্ত ডুবে ছিল। দুর্গন্ধে তাঁর মাথা ঘুরছিল, তখন তাঁর শরীর অবসন্নপ্রায়। এমন সময় তাঁর মনে হয়েছিল, যারা তাঁকে শাস্তি দিতে চায়, তারা সবাই তাঁর দিকে তাকিয়ে রয়েছে-দেখতে চাইছে কখন তিনি এই অসহ্য যন্ত্রণা আর অত্যাচারে ভেঙে পড়েন। কিন্তু এক অভূতপূর্ব গর্ববোধে হৃতশক্তি ফিরে পেলেন তিনি। শুরু করলেন গান, গলা ছেড়ে চিৎকার করে তিনি গান গাইতে লাগলেন-নিজের রচিত গান-কৃষকের গান, খামারের গান, প্রেমের গান। অত্যাচারীর অত্যাচার আর শরীরের সমস্ত নোংরা ও যন্ত্রণা যেন মুহূর্তে অদৃশ্য হয়ে গেল।…
গান, হ্যাঁ গান, গানের ভূমিকা বাদ দিয়ে ১৭৮৯ সালের ফরাসি বিপ্লবের ইতিহাসও লেখা সম্ভব নয়। ১৭৮৯ সালের ১৪ জুলাই প্যারির জনতা গান গেয়েই বাস্তিল দুর্গ দখল করেছিল। বাক ও ব্যক্তি স্বাধীনতার স্বীকৃতি আদায়ের জন্যে, সাম্য-মৈত্রী-স্বাধীনতাকে ছিনিয়ে আনার জন্যে প্রচার-প্রচারণার অসংখ্য পত্র-পত্রিকার মতোই সৃষ্টি হয়েছিল সংখ্যাতীত সঙ্গীত। এইসব গানে উচ্চকিত হয়েছিল গণদাবি, জন-আকাঙ্ক্ষা। বিপ্লব যতই এগিয়ে চলেছে, গানের সংখ্যাও বৃদ্ধি পেয়েছে স্বৈরাচারী রাজা, অভিজাতদের বিরুদ্ধে তীব্র দ্রোহে। গানের রচয়িতারা কোনো এক বিশেষ সমদায়ের ছিল না। সমস্ত বৃত্তির লোকেরাই গান লিখত, সুর করত, কাগজে ছেপে বিক্রি ও বিলি করত। কদাচিৎ গানের সঙ্গে স্বরলিপি থাকতো, বেশির ভাগ গানই হত পুরনো কোনো গানের সুরে। রচয়িতা নিজে কিংবা অন্যরা বেহালা বাজিয়ে গান গেয়ে বেড়াত। আর গানের কলি মানুষের মুখে মুখে ছড়িয়ে পড়ত ফরাসি দেশের পথে-প্রান্তরে। যার মূল কথাই ছিল স্বাধীনতা।
একবিংশ শতাব্দীর দ্বিতীয় দশকের উত্তরাধুনিক সময়ে, এই ২০১২ সালে, স্বাধীনতা হলো রুশোর মতো আত্মজিজ্ঞাসায় চিৎকার করা; নাজিমের মতো গলা খুলে মুক্তির গান গাওয়া, যে গানের স্মৃতি এখনো মিশে আছে মহান ফরাসি বিপ্লবের পরতে পরতে এবং বিশ্বের প্রতিটি মুক্তিকামী উদ্যোগে। স্বাধীনতাকে সামনে রেখে আত্মসমীক্ষার মাধ্যমে মুক্তির পথে এগিয়ে যাওয়ার চেয়ে বড় ও মহৎ কাজ আর কিছুই নেই। এই কাজটিই এখন অতীব গুরুত্বের সঙ্গে করা দরকার। মনে রাখা দরকার, রাজনৈতিক দ্বৈরথ, স্বাধীনতা, মুক্তিযুদ্ধ ও ইতিহাসের প্রবল ঘোলাজলের ঘূর্ণিমগ্ন বেনোস্রোতে সকল হিংসা-বিদ্বেষ থেকে নন্দনতাত্ত্িবক দূরত্বে দাঁড়িয়ে বলতে হবে ‘স্বাধীনতা এক নিবিড় ভালবাসার নাম’। ব্যক্তিগত ভালবাসার সমীকরণে জারিত হয়ে জাতিসত্তার ভালবাসার মোহন বাস্তবতাকে-সকল আধিপত্য, আগ্রাসন, হীনতার বাইরে পবিত্র অস্তিত্বে সংরক্ষিত করতে হবে।
স্বাধীনতার চল্লিশ বছরে আবেগ ও বাস্তবতার উথাল-পাতাল স্রোত বয়ে গেছে জাতির ইতিহাসের নদী ধরে। এমনও হয়েছে, স্বাধীনতা, স্বাধীনতার চেতনা, মুক্তিযুদ্ধও কখনও কখনও আক্রান্ত হয়েছে ভেতর ও বাইরে থেকে। বাইরের আক্রমণগুলো চেনা-জানা: সেগুলো সাম্রাজ্যবাদ, আধিপত্যবাদ, সমপ্রসারণবাদ ও আগ্রাসনবাদ-সৃষ্ট। আর ভেতর থেকে যখন স্বাধীনতা, স্বাধীনতার চেতনা, মুক্তিযুদ্ধ আহত-ক্ষত-বিক্ষত-আক্রান্ত হয় রাজনৈতিক স্বার্থান্ধতায়, দলীয়করণে, হীন ষড়যন্ত্রে তখন সমগ্র জাতিকে সতর্ক হতে হয় বৈকি। ভেতর ও বাইরে থেকে স্বাধীনতা, স্বাধীনতার চেতনা, মুক্তিযুদ্ধের বিরচদ্ধে বুনো মোষের মতো ধেয়ে আসা এই ধরনের ঐতিহাসিক সঙ্কটে, বিভ্রান্তির বেনোজলে, শাঠ্য-ষড়যন্ত্রের কুরুক্ষেত্রে দাঁড়িয়ে মানববংশের রক্তাক্ত আর্তনাদে মৌলিক সত্যের ধ্বনি-প্রতিধ্বনি করতে হয় প্রতিটি স্বাধীন সত্ত্বার মানুষকেই।
পৃথিবীর পথে পথে, দেশে দেশে, পরিবারে পরিবারে, যুদ্ধে, সংগ্রামে, দ্রোহে, সঙ্কল্পে, স্বপ্নে মানুষ রক্ত, মৃত্যু, রণাঙ্গণকে মাড়িয়ে এগিয়ে চলে সামনের ভবিষ্যতের দিকে। অতীত নয়, ভবিষ্যতই দাঁড়ায় পথ বাড়িয়ে। যুদ্ধ শেষ হয়, রক্ত শুঁকিয়ে যায়, হিংসার বাণী হাওয়ায় মিলিয়ে যায় ধ্রচবতম সত্যের প্রতিনিধি হয়ে শেষ নির্যাসরূপে থেকে যায় অমল ভালবাসা। ভালবাসার হাজার প্রদীপ জ্বালানো না গেলে কোনও অর্জনই আর অর্জন থাকে না। হিংসার বলি হয়ে গুমড়ে মরে। হিংসা, দ্বেষ, ষড়যন্ত্র, আত্মম্ভরিতা, ব্যক্তি-দল-গোষ্ঠীর সুপ্ত স্বেচ্ছাচার এবং ভেতর ও বাইরের ক্ষুদ্রতা আর আঘাতকে ঘৃণাভরে পরাজিত ও প্রত্যাখ্যান করে একজন ব্যক্তি-মানুষকে অবশেষে বলতে হয় ‘স্বাধীনতা এক নিবিড় ভালবাসার নাম’। ঐক্য ও সৌহার্দ্যের মিলিত শক্তির কাছে মানুষ ছুটে এসে তখনই সম্মিলিত কণ্ঠে বলে ওঠে: ‘পৃথিবী একটি পরিবার।্থ এসো, ‘একতা-মশাল জ্বালি’।
মানুষ শুধু বাস্তবের ব্যাখ্যাই করে না, সে ব্যাখ্যার আলোতে ভবিষ্যতের স্বপ্নও দেখে। দেশ ও পৃথিবীর মানুষকে নিয়ে এগিয়ে যেতে চায়। যে স্বপ্ন এবং এগিয়ে যাওয়া সার্বজনীন মানবসমাজের জন্য জরুরি, সত্য এবং কল্যাণকর। স্বাধীনতা তো তেমনি স্বপ্ন দেখিয়েছে পৃথিবীর দেশে দেশে – বাংলাদেশেও। বার বার নিয়ে গেছে রণাঙ্গনে, যুদ্ধে। মানবমুক্তির জন্য সেইসব যুদ্ধযাত্রাও তো এক একটি মহান স্বপ্নযাত্রা। মানবমুক্তির এক একটি মহতী পদযাত্রা। অশিক্ষা, ক্ষুধা, দারিদ্র্য, কুপমন্ডুকতা, দলীয়করণ, স্বেচ্ছাচার, স্বৈরতন্ত্রের বিরচদ্ধে স্বাধীনতা, মুক্তি, প্রকৃত আইনের শাসন ও গণতন্ত্রের ঠিকানায় অভিযাত্রা। এই পথচলাই বাংলাদেশের সাহসী মানুষের ঐতিহাসিক সংগ্রামের আরেক নাম। কবি যাকে বলেছেন: ‘মুক্তির অপূর্ণ সংগ্রাম’। এ কথাটিই হেনরি ডেভিড থরো বলেছেন আরেকটি আঙিকে: ‘‘রাষ্ট্র যে পর্যন্ত ব্যক্তিকে উচ্চতর ও স্বাধীন ক্ষমতা হিসাবে স্বীকৃতি না দেয়, যা তার নিজের ক্ষমতা ও কর্তৃত্বের উৎস, এবং যে পর্যন্ত ব্যক্তির সঙ্গে সে অনুসারে আচরণ না করে-ততক্ষণ পর্যন্ত সত্যিকারের কোনও মুক্ত ও জ্ঞানালোকিত রাষ্ট্র হবে না।’’
মানুষকে দূরে সরিয়ে, আলা্তুা করে, বিভক্ত করে, জনতাকে খন্ড-বিখন্ড করে, জনগণের মধ্যে বিভেদের-কালাপাহাড় তুলে কি সম্ভব মিলিত কণ্ঠে কোনদিনও গাওয়া ঃ ‘স্বাধীনতা এক নিবিড় ভালবাসার নাম’। হিংসা ছড়িয়ে তো ভালবাসার গান গাওয়া যায় না? অথচ মানুষ প্রাকৃতিকভাবেই ভালবাসার গান গাইতে চায়, স্বাধীনতার গান গাইতে চায়। হিংসার গান গাইতে চায় না, ঐক্যের প্রতিধ্বনি করতে চায়। স্বাধীনতার চল্লিশোর্ধ বছরে মানুষের কণ্ঠে ভালবাসার গান হয়ে, ঐক্যের ধ্বনি হয়ে, সতত উচ্চারিত হচ্ছে ‘স্বাধীনতা’। জনগণের সেই কণ্ঠস্বর ইতিহাসের মহাপ্রাচীরে ধ্বনিত-প্রতিধ্বনি হয়ে ছড়িয়ে পড়ছে গ্রাম থেকে শহরে, নগরের অলিন্দে-অলিন্দে, বন্দরে-সাগরে-জাহাজে-পর্বতে’ সারা বাংলাদেশে পৃথিবীর কেন্দ্রে ও প্রান্তে প্রান্ত্তেমানুষের হৃদয়ে হৃদয়ে। বাংলাদেশের ঐতিহাসিকক্ষণে স্বাধীনতা ও মুক্তির আলোয় উদ্বেলিত সমগ্র জাতিসত্তা, অতীতের অর্জনকে সঙ্গী করে ভবিষ্যতের স্বর্ণালী পথে সূচিত অভিযাত্রা নিবিড় ভালবাসার শক্তিতে পৌঁছাবে সাফল্যের কাঙ্খিত ঠিকানায়। (মুহাম্মদ আলতাফ হোসেন প্রবীণ সাংবাদিক ও কলাম লেখক)