ঢাকা টাইমস্ রিপোর্ট ॥ হিউম্যান রাইটস ওয়াচ যে অভিযোগ উত্থাপন করেছে তার জোরালো প্রতিবাদ করেছে র্যাব। র্যাব বলেছে, হিউম্যান রাইটস ওয়াচ নিজেরাই ‘কুখ্যাত’।
গতকাল ৪ জুলাই আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংগঠন হিউম্যান রাইটস ওয়াচ র্যাবের বিরুদ্ধে যে অভিযোগ উত্থাপন করেছে তার জোরালো প্রতিবাদ করেছে র্যাব। মানবাধিকার লংঘনের অভিযোগ প্রত্যাখ্যান করে র্যাব দাবি করেছে, মানবাধিকার সংস্থা হিউম্যান রাইটস ওয়াচের (এইচআরডব্লিউ) প্রতিবেদন ভিত্তিহীন এবং মনগড়া। আন্তর্জাতিক এ সংস্থার এ প্রতিবেদনের উদ্দেশ্য নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে র্যাব। এর মাধ্যমে ওই সংস্থার কুখ্যাত চেহারা উন্মোচিত হয়েছে বলেও র্যাব দাবি করেছে।
৪ জুলাই সকালে ব্র্যাক ইন সেন্টারে সংবাদ সম্মেলনে নিউইয়র্কভিত্তিক আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থা হিউম্যান রাইটস ওয়াচ বিডিআর সদস্যদের ওপর নির্যাতনের অভিযোগ এনে র্যাবকে বিলুপ্ত করার সুপারিশসহ প্রতিবেদন প্রকাশ করে।
রাজধানীর মহাখালীর ব্র্যাক ইন সেন্টারে এক সংবাদ সম্মেলনের আয়োজন করে আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থা হিউম্যান রাইটস ওয়াচ (এইচআরডব্লিউ), ওই সংবাদ সম্মেলনে ‘ভয় আমাকে ছাড়ে না : ২০০৯ এর বিডিআর বিদ্রোহের পর হেফাজতে মৃত্যু, নির্যাতন ও পক্ষপাতদুষ্ট বিচার’ শীর্ষক ৫৭ পাতার একটি গবেষণা প্রতিবেদন প্রকাশ করে সংস্থাটি। ওই প্রতিবেদনে বিডিআর সদস্যরা ন্যায়বিচার পাবে কিনা তা নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করে এ ব্যাপারে নানা অভিযোগ তুলে সরকারের কাছে কিছু সুপারিশ করা হয়েছে। এতে সংস্থাটির এশিয়া বিভাগের নির্বাহী পরিচালক ব্রাড অ্যাডামস, একই সংস্থার দক্ষিণ এশিয়া বিভাগের তেজশ্রি থাপা এবং আইন ও সালিশ কেন্দ্রের পরিচালক নূর খান উপস্থিত ছিলেন।
সংবাদ সম্মেলনে প্রতিবেদনের উদ্ধৃতি দিয়ে হিউম্যান রাইটস ওয়াচের ‘এইচআরডব্লিউ’ এশিয়া বিভাগের নির্বাহী পরিচালক ব্রাড অ্যাডামস বলেন, বাংলাদেশে ২০০৯-এর বিডিআর বিদ্রোহ ও হত্যায় সন্দেহভাজন বিডিআর সদস্যদের ওপর রাষ্ট্রীয় হেফাজতে প্রচণ্ড নির্যাতন করা হয়েছে। এতে কমপক্ষে ৪৭ জন মারা গেছেন। বিশেষ ট্রাইব্যুনালে এই বিদ্রোহ ও হত্যার বিচার পক্ষপাতদুষ্ট গণবিচার। কুখ্যাত র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র্যাব) এই নির্যাতনগুলোর অনেকগুলোর সঙ্গে সংশ্লিষ্ট বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে।
পরিচালক ব্রাড অ্যাডামস বলেন, র্যাব ভেঙে দিয়ে পুলিশের মধ্যে একটি অসামরিক ইউনিট বা নতুন সংস্থা তৈরি করা হোক, যারা অপরাধ ও সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের সময় এর ভিত্তি হিসেবে মানবাধিকারগুলোকে গুরুত্ব দেবে। র্যাব, ডিজিএফআই এবং অন্যান্য সুরক্ষাবাহিনীর হাতে দীর্ঘদিন ধরে চলা ব্যাপক নির্যাতন ও খারাপ আচরণের অভিযোগগুলো বিবেচনা করতে ‘প্রকৃত ও অর্থপূর্ণ’ পদক্ষেপ গ্রহণ করারও আহ্বান জানিয়েছে সংস্থাটি। তিনি বলেন, বিডিআর বিদ্রোহের ঘটনায় অভিযুক্তদের যারা বিচার করছে তারা সরকারের নির্বাহী বিভাগের লোক। যারা বিচারক তারা বিচার বিভাগের লোক নন। তিনি জানান, তাদের এ প্রতিবেদনটি নিয়ে তারা মঙ্গলবার স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করেছেন। তবে ওই বিচারের ক্ষেত্রে মানবাধিকারের লংঘন হয়নি বলে মন্ত্রী মনে করেন।
প্রতিবেদনটিতে দেখা যায়, এতে বিদ্রোহের একটি বিস্তারিত বর্ণনাসহ সন্দেহভাজন বিদ্রোহীদের ওপর সরকারি বাহিনীর নির্যাতনের ঘটনাগুলো প্রামাণ্য আকারে তুলে ধরা হয়েছে। নির্যাতিত ও নিহতদের পরিবারের সদস্য, দুই পক্ষের আইনজীবীসহ মোট ৬০ জনের সাক্ষাৎকার নেয়া হয়েছে। নির্যাতিতদের ‘হাতের ও পায়ের নখ উপড়ে ফেলা’, ‘বৈদ্যুতিক শক দেয়া’ ও ‘সিলিংয়ের সঙ্গে উল্টো করে ঝুলিয়ে রাখা’সহ নানা ধরনের নির্যাতনের বর্ণনা দেয়া হয়েছে এতে।
এইচআরডব্লিউর প্রতিবেদনটিতে উল্লেখ করা হয়েছে, সংস্থাটি এ ব্যাপারে উদ্বিগ্ন যে, এই বিচারগুলোকে গণবিচার হিসেবে চালানো হচ্ছে। যেখানে আটশ’রও বেশি অভিযুক্তের বিচার একসঙ্গে করা হচ্ছে। বিশেষ ট্রাইব্যুনালগুলোতে গণবিচারের মাধ্যমে ইতিমধ্যে প্রায় চার হাজার বিডিআর সদস্যকে অপরাধী সাব্যস্ত করা হয়েছে। ফৌজদারি কার্যবিধি অনুসারে বিশেষভাবে গঠিত বেসামরিক আদালতে (বিশেষ আদালত) হত্যা ও অন্যান্য গুরুতর অপরাধের অভিযোগের বিচারে এমনকি ৮৪৭ জন লোকের বিরুদ্ধে একটিমাত্র মামলায় শুনানি করা হয়েছে। যেই মামলাটিতে অন্তর্ভুক্ত অনেক অপরাধে মৃত্যুদণ্ডের শাস্তির বিধানও আছে।
এর পরপরই বিকালে উত্তরায় পাল্টা সংবাদ সম্মেলন করে র্যাব। এ সময় র্যাবের আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক কমান্ডার এম সোহায়েল বলেছেন, দেশীয় কিছু ভুইফোঁড় মানবাধিকার সংস্থার প্ররোচনায় এই মানবাধিকার সংস্থাটি উদ্দেশ্যমূলক প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। এই প্রতিবেদন প্রকাশের পেছনে বিশেষ কোন এজেন্ডা বাস্তবায়নের প্রচেষ্টা থাকতে পারে। এম সোহায়েল বলেন, বিডিআরের মামলার সঙ্গে র্যাবের কোন সম্পৃক্ততা নেই। ফলে র্যাব হেফাজতে কাওকে নির্যাতনের প্রশ্নই আসে না। ওই মামলা সিআইডি তদন্ত করেছে, র্যাব করেনি। বিজিবি তাদের নিজস্ব আইন অনুসারে বিচার কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে। তাই বিডিআর বিদ্রোহের ঘটনায় সন্দেহভাজন ও অভিযুক্তদের ওপর র্যাবের নির্যাতনের অভিযোগ পুরোপুরি অসত্য ও ভিত্তিহীন। র্যাব কর্মকর্তা বলেন, কোন সংস্থা কর্তৃক কোন সংস্থার বিষয়ে সংবাদ বা অভিযোগ প্রকাশের আগে বিষয়টি যাচাইয়ের জন্য সংশ্লিষ্ট সংস্থার বক্তব্য নেয়ার রীতি রয়েছে। অথচ র্যাবের বিরুদ্ধে বিদ্রোহী বিডিআর সদস্যদের ওপর নির্যাতনের অভিযোগ আনলেও র্যাবের কোন বক্তব্য নেয়নি মানবাধিকার সংস্থা হিউম্যান রাইটস ওয়াচ।
উল্লেখ্য, সামপ্রতিক সময়ে দেশের আভ্যন্তরীণ বিষয়ে বিদেশী সংস্থাগুলোর নাক গলানোর মনোভাব খুব বেশি আকারে দেখা দিয়েছে, যা স্বাভাবিকভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়। তাছাড়া একটি দেশের কোন আইন প্রয়োগকারী সংস্থার বিরুদ্ধে মানবাধিকার সংগঠনগুলো অভিযোগ করতেই পারে। কিন্তু তাই বলে সেই সংস্থাকে বিলুপ্তি করার কথা বলতে পারে না।