এম. এইচ. সোহেল ॥ “পাকিস্তানের কাছে বাংলাদেশ ক্ষমা চাওয়ার দাবি তোলেনি। ক্ষমা চাওয়ার ইস্যুতে নয়, নিজের অসুস্থতার জন্য বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পাকিস্তান সফরে যেতে অপারগতা প্রকাশ করেছেন।” এ দাবি করেছেন পাকিস্তানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিনা রব্বানী খার। আর এ কথার মাধ্যমে প্রমাণ হয়েছে, বাংলাদেশের দাবি যৌক্তিক। বাংলাদেশের কাছে পাকিস্তানের ক্ষমা চাওয়া এখন শুধুই সময়ের ব্যাপার।
১৯৭১ সালে পাকিস্তান বাংলাদেশের জনগণের ওপর যে অত্যাচার-নির্যাতন করেছিল তার জন্য ক্ষমা চাওয়ার সময় এসেছে। বিশ্বের বিভিন্ন দেশেই এর নজিরও রয়েছে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের বহুবছর পর জার্মানি যেমন ক্ষমা চেয়েছিল ঠিক তেমনি দীর্ঘ ৪০ বছর পার হলেও এখন যারা পাকিস্তানের ক্ষমতায় আছেন পাকিস্তানের পূর্বের কৃতকর্মের জন্য বাংলাদেশের কাছে ক্ষমা চাওয়া উচিত। কারণ ক্ষমা চাইলে কেও ছোট হয়ে যায় না। তাছাড়া ১৯৭১ সালের কাহিনী সকলের যানা। ১৯৭১ এ পাকিস্তানী বাহিনী দেশ রক্ষার নাম করে যেভাবে বৃদ্ধ, শিশু, নারীদের ওপর যেভাবে অত্যাচার-নির্যাতন চালিয়ে ছিল সমগ্র বিশ্ববাসী সেদিন অবলোকন করেছে সে দৃশ্য। ইতিহাসের এক জঘণ্যতম হত্যাযজ্ঞ চালিয়ে ছিল সেদিন পাক বাহিনী। মুসলমান হয়ে অপর মুসলমান মা-বোনের ওপর সেদিন যে জুলুম নির্যাতন চালানো হয়েছিল তা ইতিহাসে আজও জঘণ্যতম ঘটনা হিসেবে পরিগণিত হয়ে আছে।
বিভিন্ন সরকারের সময় দাবি উঠলেও বর্তমান সরকার আওয়ামীলীগ সরকারের নেতৃত্বে এদেশ স্বাধীন হয়েছিল। আর তাই এই সরকার যখনই ক্ষমতায় এসেছে, তখনই পাকিস্তানের ক্ষমা চাওয়ার বিষয়টি উঠে এসেছে। ১৯৯৬ সালে আওয়ামীলীগ সরকার ক্ষমতায় আসার পর এই দাবিতে সোচ্চার হয় এদেশের জনগণ। আবার বর্তমান সরকার ক্ষমতায় আসার পরও বিভিন্ন সভা-সমাবেশে এবং সেমিনারে বার বার এই বিষয়টি উঠে এসেছে। একদিন হয়তো এই পাকিস্তান ক্ষমা চাইবে। তবে সেটি যত তাড়াতাড়ি হতে ততই মঙ্গল।
একজন মুক্তিযোদ্ধার বক্তব্য
ক্ষমা চাওয়ার বিষয়ে আলাপ হয় ১৯৭১ সালে এদেশের মাটির জন্য যুদ্ধ করেছেন এমন একজন মুক্তিযোদ্ধার সঙ্গে। পাবনা-৪ আসনের মাননীয় সংসদ সদস্য শামসুর রহমান শরীফ ডিলু বলেন, আজ হোক আর কাল হোক একদিন পাকিস্তানকে ১৯৭১ সালের জন্য বাংলাদেশের জনগণের কাছে ক্ষমা চাইতেই হবে। তিনি মনে করেন, পাকিস্তান ১৯৭১ সালে বাঙালিদের ওপর যে জুলুম নির্যাতন করেছে তার জন্য তাদের অনুতপ্ত হতেই হবে। কারণ ১৯৭১ সালের বর্বরোচিত হামলার ঘটনা ইতিহাসে এক কালের স্বাক্ষী হয়ে চিরদিন রয়ে যাবে। এর নৃশংসতা কোনদিন মুছে ফেলা যাবে না। তিনি মনে করেন, পাকিস্তানের উচিত বাংলাদেশের জনগণের কাছে ক্ষমা চাওয়া।
ডি-৮ প্রসঙ্গ
ডি-৮ শীর্ষ সম্মেলনে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার যোগদান করার কথা থাকলেও হঠাৎ করে তা বাতিল হয়। আর তখনই শুরু হয় এই আলোচনা-সমালোচনা। অনেকেই ধারণা করেন পাকিস্তান বাংলাদেশের কাছে ক্ষমা চাওয়ার বিষয়টি যুক্ত আছে বলেই প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ডি-৮ শীর্ষ সম্মেলনে যোগ দেননি। আর এ থেকেই আবার নতুন করে শুরু ১৯৭১ এর কাহিনী। তবে এ বিষয়ে পাকিস্তানী পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিনা রাব্বানী খার বক্তব্য এ দেশের সচেতন বাঙালিদের আবার স্মরণ করিয়ে দিয়েছে ১৯৭১ সালের পাকিস্তানের ভূমিকা নিয়ে। এমন অবস্থা হয়েছে, ‘মাচির নিচে কে রে?… আমিতো গুড় খাইনি’ এমন অবস্থা। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পাকিস্তানে ডি-৮ শীর্ষ সম্মেলনে যোগ দেওয়া না দেওয়া নিয়েতো সরকারিভাবে কখনই এমন কথা বলা হয়নি যে, ‘ক্ষমা চাইলে যোগ দেবে নইলে নয়,’ কিন্তু পাক পররাষ্ট্রমন্ত্রী নিজে থেকেই এ প্রশ্নে সৃষ্টি করেছেন। কারণ পাকিস্তানের অনেক মানবাধিকার কর্মীই বহুবার বলেছেন, ১৯৭১ সালের ঘটনার জন্য বাংলাদেশের কাছে পাকিস্তানের ক্ষমা চাওয়া উচিত।
উল্লেখ্য, কিছুদিন আগে পাক পররাষ্ট্রমন্ত্রী বাংলাদেশ সফর করেন। সে সময় ১৯৭১ সালের স্বাধীনতা যুদ্ধে সংঘটিত নৃশংসতার জন্য পাকিস্তানকে ক্ষমা চাওয়ার আহ্বান জানানো হয়। কিন্তু হিনা রব্বানী খার তাতে অস্বীকৃতি জানান। তিনি পাকিস্তানের রাজধানী ইসলামাবাদে অনুষ্ঠেয় ডি-৮ শীর্ষ সম্মেলনে যোগ দিতে অনুরোধ করেন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীকে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তাতে অস্বীকৃতি জানান। এর পরই খবর ছড়িয়ে পড়ে যে, পাকিস্তান ক্ষমা না চাওয়ার জন্য শেখ হাসিনা পাকিস্তানের ওই সম্মেলনে যাওয়ার আমন্ত্রণ প্রত্যাখ্যান করেছেন। এ ধরনের খবর প্রত্যাখ্যান করেছেন হিনা রব্বানী খার। তবে তিনি কোথায় এসব কথা বলেছেন তা রিপোর্টে উল্লেখ করা হয় নি। ২০ নভেম্বর এ খবর দিয়েছে বার্তা সংস্থা পিটিআই। এতে বলা হয়, আগামীকাল থেকে ইসলামাবাদে শুরু হচ্ছে ডি-৮ সম্মেলন। এ সম্মেলনে যোগ দেয়ার জন্য শেখ হাসিনাকে ব্যক্তিগতভাবে আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন হিনা রব্বানী খার। তখন বাংলাদেশ পাকিস্তানের কাছে ক্ষমা চাওয়ার দাবি তোলেনি। হিনা রব্বানীর গত ৯ই নভেম্বরের সফরের সময় বাংলাদেশের নেতারা তাকে উষ্ণ অভ্যর্থনা জানিয়েছেন বলে তিনি জানান। তিনি বলেন, পাকিস্তানকে ক্ষমা চাওয়ার যেসব দাবির কথা বলা হচ্ছে তা পুরোপুরি ভুল। তিনি বলেন, বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর চোখে কিছুটা সমস্যা ছিল। তাই তার চিকিৎসকরা তাকে সফরে না যেতে পরামর্শ দিয়েছেন। ওদিকে পাকিস্তানের মিডিয়ায় খবর প্রচারিত হয়েছে যে, ১৯৭১ সালে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে (বর্তমানে বাংলাদেশ) পাকিস্তানি বেসামরিক কর্মকর্তা ও সামরিক কর্মকর্তারা যে যুদ্ধাপরাধ করেছেন তার জন্য পাকিস্তানকে ক্ষমা চাওয়ার আহ্বান জানিয়েছে বাংলাদেশ। কিন্তু পাকিস্তান তাতে অস্বীকৃতি জানানোয় শেখ হাসিনা ডি-৮ শীর্ষ সম্মেলনে যোগ না দেয়ার কথা জানিয়ে দিয়েছেন। তবে হিনা রব্বানী খার বলেন, ওই সম্মেলনে যোগ দিচ্ছেন মিশরের প্রেসিডেন্ট মোহাম্মদ মুরসি, ইন্দোনেশিয়ার প্রেসিডেন্ট সুসিলো বামবাং ইয়োধইয়োনো, ইরানের প্রেসিডেন্ট মাহমুদ আহমাদিনেজাদ, নাইজেরিয়ার প্রেসিডেন্ট গুডলাক ইবেলি জোনাথান, তুরস্কের প্রধানমন্ত্রী রিসেপ তায়েপ এরদোগান। এতে মালয়েশিয়া তার উপ-প্রধানমন্ত্রীকে এবং বাংলাদেশ থেকে একজন বিশেষ প্রতিনিধি যোগ দিতে পারেন। এই সম্মেলনের উদ্বোধন করবেন পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট আসিফ আলী জারদারি। সভাপতিত্বও করবেন তিনি। এ সম্মেলন থেকে পরবর্তী দুই বছরের জন্য ডি-৮-এর চেয়ারম্যান করা হবে পাকিস্তানকে।