দি ঢাকা টাইমস্ ডেস্ক॥ একদিকে প্রাণঘাতি করোনা ভাইরাস আতঙ্ক। অপরদিকে ভালোবাসা। আতঙ্ককে প্রাধান্য দিয়ে যদি কোয়ারেন্টিনে চলে যান তাহলে ভালোবাসাকে কাছে পাওয়ার হয়তো সুযোগ আর নাও আসতে পারে।
সবচেয়ে বড় কথা প্রেমিক-প্রেমিকা খুব করে চাইছিলেন একে অন্যকে কাছে পাওয়ার জন্য। তাই করোনা আতঙ্ক তাদের কাছে তুচ্ছ হয়ে যায়। তারা ঘরোয়া পরিবেশে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন। এমন কাহিনী রূপকথায় শোনা গেলেও বৃটেনে এমন কাহিনীই বাস্তবে রূপ নিয়েছে। অবাক করার মতো বিষয় হলো, এই প্রেমিক হলেন ১০০ বছর বয়সী ইয়াবর আব্বাস।
তার প্রণয়ী হলেন ৬০ বছর বয়সী ভারতীয় অধিকারকর্মী এবং লেখিকা নূর জহির। প্রেমের এমন উদ্দামতা তরুণ-তরুণীদের মধ্যে থাকলেও তারা যেনো এই যুগের তরুণদের পিছনে ফেলে ভালোবাসার জয় পেয়ে গেছেন। তাই তাদের ভালোবাসা, বিয়ের কাহিনী উঠে এসেছে আন্তর্জাতিক সংবাদ মাধ্যমগুলোতে। এর মধ্যে পাকিস্তানের অনলাইন ডন একটি সচিত্র প্রতিবেদনও প্রকাশ করেছে।
এই ইয়াবর আব্বাস হলেন বৃটেনভিত্তিক চলচ্চিত্র নির্মাতা এবং বিবিসি’র সাবেক সাংবাদিক। অপরদিকে নূর জহির ভারতীয় অধিকারকর্মী এবং লেখিকা। তাদের মধ্যকার ভালোবাসার কেমিস্ট্রি সম্পর্কে ইয়াবর আব্বাস বলেছেন, করোনা আতঙ্ককে পিছনে ফেলে এই বিয়ের উদ্দেশ্যই হলো ভালোবাসা। আমরা দু’জনে ভালোবাসায় ডুবে গিয়েছি। আমার বয়স কতো আসলে সেটা কোনো বিষয়ই নয়। সে (নূর জহির) বয়স সবে ৬০ বছর পেরিয়েছে। তবুও বয়সের এই ব্যবধান আমাদের কাছে কিছুই না। আমরা বিয়ে করে একত্রিত হতে পেরে খুবই আনন্দ অনুভব করছি।
২৭ মার্চ তাদের বিয়ের তারিখ নির্ধারণ করা হয়। তবে করোনা ভাইরাস সংক্রমণ এবং এই সম্পর্কে সরকারি যেসব নির্দেশনা তাতে করে তাদের সেইসব পরিকল্পনা ভেস্তে যেতে বসে। বৃটেনে একে একে বাড়তে থাকে আক্রান্ত এবং মৃতের সংখ্যাও। এর প্রেক্ষিতে বৃটিশ সরকার লকডাউনের দিকে অগ্রসর হতে পারে বলেও আশঙ্কা দেখা দেয়। এমন হলে নির্ধারিত তারিখে তারা বিয়েও করতে পারবেন না। যে কারণে সব আয়োজন ব্যর্থ হয়ে যাবে। এই বিষয়টি নিয়ে ভাবতে থাকেন ইয়াবর আব্বাসও।
ইয়াবর আব্বাস বলেন, যখন আমরা জানতে পারলাম যাদের বয়স ৭০ বছরের ওপরে তাদের সেলফ-আইসোলেশনে কিংবা নিজেকে পৃথক করে ফেলতে বলা হবে, তখন একটি বাসে করে আমরা বিয়ে রেজিস্ট্রার অফিসে গেলাম। তাদের কাছে জানতে চাইলাম আমাদের সামনে কোনো বিকল্প পরিকল্পনা রয়েছে কিনা। তবে তারা কোনো বিকল্পই দেখাতে পারলেন না। তারা আমাদেরকে বললেন যে, আইসোলেশন পিরিয়ড শুরু হলে আমরা আর বিয়ে করতে পারবো না। তারপরই আমরা সিদ্ধান্ত নিলাম আর বিলম্ব করবো না। আমরা এবার বিয়ে করে ফেলবো। এই অবস্থায় তাদের সামনে যে সুযোগ ছিল তা হলো একঘণ্টার মধ্যে বিয়ে করে ফেলা কিংবা পরের দিন সকালে বিয়ে করা। আমাদের সামনে এতো স্বল্প সময় থাকায় অতিথিদের ডাকতেও পারলাম না। তাছাড়া এটা সম্ভবও ছিল না। তাই পরের দিন সকালে ১৭ মার্চ আমরা বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হতে রাজি হলাম।
ইয়াবর আব্বাস আরও বলেন, অবশ্য একটা বিকল্প ছিল। আর তা হলো বিয়ের রেজিস্ট্রারকে তাদের বাসভবনে ডেকে নিয়ে বিয়ের রেজিস্ট্রেশনটা করা। তবে সেটা করতে হলে আগে থেকেই আবেদন দিতে হয়। এমন আবেদন দিতে হলে আরও একমাস বিলম্ব হবে বিয়ে করতে। তাই ‘আমরা সময় অপচয় না করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করি’। যে কারণে পরের দিন তাদের বাসায় ছোট্ট পরিসরে আয়োজন হলো বিয়ের অনুষ্ঠান। সেই অনুষ্ঠানে অতিথি হিসেবে যোগ দিলেন মাত্র ৬ জন। তার মধ্যেই সম্পন্ন করা হলো বিয়ে।
ইয়াবর আব্বাসের মূল বাড়ি ভারতের উত্তর প্রদেশের লক্ষ্মৌতে। তিনি দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় বৃটিশ সেনাবাহিনীর ফটোগ্রাফার হিসেবে ক্যারিয়ার শুরু করেছিলেন। ওই সময় তাকে পোস্টিং দেওয়া হয় মিয়ানমারে। ১৯৪৫ সালে জাপানে আত্মসমর্পণের ডকুমেন্টারি করেছিলেন যারা, তাদের অন্যতম ছিলেন তিনি। তিনি ১৯৫০ হতে ২০০৯ সাল পর্যন্ত বিভিন্ন সময়ে বিবিসি উর্দু বিভাগের সঙ্গে কাজ করেছেন।
স্ত্রী নূর জহিরের ভূয়সী প্রশংসা শোনা গেলো ইয়াবর আব্বাসের মুখে। তিনি ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি বিরোধী বিক্ষোভের একজন নির্ভীক কর্মী। এমন কর্মকাণ্ডে জড়িত থাকার জন্য নূর জহিরের জন্য গর্ববোধ করেন আব্বাস। এখানে উল্লেখ্য, বিখ্যাত উর্দু লেখক ও রাজনৈতিক বোদ্ধা সাজ্জাদ ও রাজিয়া সাজ্জাদ জহিরের চার মেয়ের মধ্যে নূর জহির হলেন অন্যতম। তিনি তার লেখনি ও কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে তার পিতামাতার বৈশিষ্ট্যকে ভারতে বহাল রেখেছেন। তিনি কমিউনিস্ট পার্টি অব ইন্ডিয়ার একজন সদস্য এবং ইন্ডিয়ান পিপলস থিয়েটারের সাবেক প্রেসিডেন্ট। নূর জহিরের লেখা অন্তত ১৫টি বই প্রকাশিত হয়েছে। যার মধ্যে রয়েছে ‘মাই গড ইজ এ ওম্যান’, ‘দ্য ড্যান্সিং লামা’, ‘ডিনাইড বাই আল্লাহ’, ‘সুখ কারওয়ান কি হামসাফার’, ‘রাইত পে কাহানি’ ও ‘মার্সি হিসি কি রোশনাই’ উল্লেখযোগ্য।
প্রাণঘাতি রোগ করোনা ভাইরাসের ঝুঁকি নিয়ে উদ্বিগ্ন কিনা এমন প্রশ্ন করা হলে নূর জহির বলেন যে, আমরা দু’জনই যেহেতু সক্ষম, আমি ব্যক্তিগতভাবে মহামারীতে মোটেও ভীত নই। কারণ হলো একজন অধিকারকর্মী হিসেবে ভারতের প্রত্যন্ত এলাকায় আমি কাজ করেছি। সেখানে মারাত্মক স্বাস্থ্যঝুঁকির মুখোমুখিও হয়েছি। তবে সেটা অবশ্যই এই মহামারীর মতো ভয়াবহ নয়। তিনি আরো জানিয়েছেন যে, তাদের দাম্পত্য জীবনের প্রথম দিনগুলো সেল্ফ আইসোলেশনেই কাটাবেন। এই সময় প্রচুর বই পড়বেন তিনি। দু’জনে মিলে মনের কথাও বলবেন। গল্পও করবেন। জীবনের শেষ বিকেলে দাঁড়িয়ে কাঁচা সোনার মতোই রোদের ঝিলিকে হাসবেন।
তাদের বয়সের পার্থক্য সম্পর্কে নূর জহির বলেন, আমরা বয়সটাকে অনেক বেশি গুরুত্ব দিয়ে থাকি। তবে ভালোবাসার জন্য উপযুক্ত কোনো বয়স বলে কিছু নেই।
# দেশে বিদেশে অবলম্বনে