দি ঢাকা টাইমস্ ডেস্ক ॥ এমন একটি ভাইরাস- যা ইতিপূর্বে বিজ্ঞানীদের অজানা ছিল- এরই মধ্যে চীনে অনেক মানুষের ফুসফুসের মারাত্মক রোগ সৃষ্টি করে মৃত্যু ঘটিয়েছে এবং এটি অন্যান্য দেশেও ধরা পড়েছে।
চীনের উহানে গত ডিসেম্বর মাস হতে সনাক্ত হওয়া ভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে এ পর্যন্ত কমপক্ষে দেড় শত জন মারা গেছে। এসব মৃত্যুর ব্যাপারে ইতিমধ্যেই নিশ্চিত হওয়া গেছে এবং বিশেষজ্ঞদের আশঙ্কা যে, এই সংখ্যা আরও বাড়তে পারে।
এটি রোগীদের শরীরে নিউমোনিয়া তৈরি করছে, এই ভাইরাসটি সবসময়েই উদ্বেগজনক। যে কারণে সারা বিশ্বের স্বাস্থ্য কর্মকর্তারা চরম সতর্ক অবস্থায় রয়েছেন।
এটা কি আজকালের একটি প্রাদুর্ভাব নাকি আরও বিপজ্জনক কোন রোগের লক্ষণ? এই ভাইরাসটিই বা কী?
চীনের কর্মকর্তারা নিশ্চিত করেছেন, করোনা ভাইরাসের কারণেই সেখানে অসুস্থতা বা মৃত্যুর ঘটনাগুলো ঘটেছে। করোনা ভাইরাস এমন একটি সংক্রামক ভাইরাস – যা এর আগে কখনও মানুষের মধ্যে দেখা যায়নি।
ভাইরাসটির আরেক নাম হলো ২০১৯-এনসিওভি অর্থাৎ ২০১৯ নভেল করোনা ভাইরাস। এটি এক ধরণের করোনা ভাইরাস। করোনা ভাইরাসের অনেক রকম প্রজাতিও নাকি রয়েছে, কিন্তু এর মধ্যে মাত্র ৬টি মানুষের দেহে সংক্রমিত হতে পারে। তবে নতুন ধরণের ভাইরাসের কারণে সেই সংখ্যা এখন থেকে হবে ৭টি।
২০০২ সাল থেকে চীনে মহামারী আকারে ছড়িয়ে পড়া সার্স (যে রোগের পুরো নাম সিভিয়ার এ্যাকিউট রেসপিরেটরি সিনড্রোম) নামে যে ভাইরাসের সংক্রমণে পৃথিবীতে ৭৭৪ জনের মৃত্যু ঘটেছিলো এবং ৮০৯৮জন সংক্রমিত হয়েছিলেন। সেটিও ছিল এক ধরণের করোনাভাইরাস।
‘সার্সের ভয়াবহ অভিজ্ঞতা এখনও আমরা ভুলতে পারিনি, যে কারণে নতুন ভাইরাসের প্রচণ্ড ভীতিও তৈরি হয়েছে। তবে এই ধরণের রোগ মোকাবেলায় আমরা এখন অনেক বেশি প্রস্তুত,’ বিষয়টি বলেছেন ওয়েলকাম ট্রাস্টের চিকিৎসক জোসি গোল্ডিং।
লক্ষণগুলো কতোটা মারাত্মক হতে পারে?
জ্বর দিয়ে ভাইরাসের সংক্রমণ শুরু হলেও, এরপর দেখা দিতে পারে শুকনো কাশি। প্রায় এক সপ্তাহ পরে শ্বাসকষ্ট শুরু হয়ে যেতে পারে। অনেক রোগীকেই হাসপাতালে ভর্তি করে চিকিৎসা দিতে হয়।
হাসপাতালে ভর্তিকৃত রোগীদের মধ্যে প্রতি চারজনের মধ্যে অন্তত একজনের অবস্থা মারাত্মক পর্যায়ে যায় বলে মনে করা হয়।করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত রোগীদের মধ্যে হালকা ঠাণ্ডা লাগা হতে শুরু করে মৃত্যুর সব উপসর্গই দেখা দিতে পারে।
‘যখন আমরা করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত কাওকে দেখতে পাই যে, আমরা বোঝার চেষ্টা করি লক্ষণগুলো আসলে কতোটা মারাত্মক। এটা ঠাণ্ডা লাগার লক্ষণগুলোর চেয়ে একটু বেশি, সেটি উদ্বেগজনক হলেও, সার্সের মতো অতোটা মারাত্মক নয়,’ বিষয়টি বলেছেন ইউনিভার্সিটি অফ এডিনবরার অধ্যাপক মার্ক উলহাউজ।
রোগটি কোথা থেকে এলো?
বিশ্বে মাঝে মধ্যেই নতুন নতুন ভাইরাস সনাক্ত হয়ে থাকে। কোনো একটি প্রাণী থেকে এসে এসব ভাইরাস মানব শরীরে বাসা বাধতে শুরু করে দেয়।
নটিংহ্যাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইরাস বিশেষজ্ঞ জোনাথন বল এই ভাইরাস সম্পর্কে বলেছেন, ‘আমরা যদি অতীতের মহামারিগুলোর দিকে তাকাই, এমনকি এটা যদি নতুন করোনা ভাইরাসও হয়, এটা কোন একটা প্রাণীর শরীর থেকেই এসেছে। সার্স ভাইরাস প্রথমে বাদুরের শরীর হতে খট্টাশের শরীরে, এরপর সেটি মানব শরীরে চলে আসে।’
মধ্যপ্রাচ্যের ফুসফুসের রোগ মার্স (যার পুরো নাম: মিডল ইস্ট রেসপিরেটরি সিনড্রোম), যাতে ২৪৯৪ জন সংক্রান্ত রোগীর মধ্যে ৮৫৮ জনই মারা গিয়েছিলেন, রোগটি নিয়মিতভাবে এক কুঁজওয়ালা উট হতে মানব শরীরে ছড়িয়ে পড়ে।
কোন প্রাণী থেকে ছড়িয়েছে এই করোনা ভাইরাস?
একবার যদি ভাইরাসের উৎস প্রাণীটি সনাক্ত করা সম্ভব হতো, তাহলে রোগটি মোকাবেলা করা অনেক সহজ হয়ে যেতো।করোনা ভাইরাসের সঙ্গে সম্পর্ক রয়েছে চীনের উহায়ের দক্ষিণ সমুদ্রের খাবারের পাইকারি বাজারের সঙ্গে।
তবে বেশ কিছু সামুদ্রিক প্রাণীও করোনা ভাইরাস বহন করতে পারে (যেমন- বেলুগা তিমি), চীনের ওই বাজারটিতে অনেক জীবন্ত প্রাণীও থাকে, যেমন মুরগি, বাদুর, খরগোশ, সাপ- এসব প্রাণীও করোনা ভাইরাসের উৎস হতে পারে। এই বিষয়ে গবেষকরা বলছেন, চীনের হর্সশু নামের একপ্রকার বাদুরের সঙ্গে এই ভাইরাসের ঘনিষ্ঠ মিলও রয়েছে।
চীনে কেনো এই ভাইরাস?
অধ্যাপক উলহাউজ এই বিষয়ে বলেছেন, এর বড় একটা কারণ হলো চীনের বিশাল আকৃতি এবং জনসংখ্যার ঘনত্ব ও যেসব প্রাণী ভাইরাসটি বহন করে, সেগুলোর সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ইত্যাদি। তিনি আরও বলেছেন, ‘পরবর্তী বড় মহামারি চীন বা এই অঞ্চলে হলে অবাক হওয়ার কিছুই থাকবে না।’
মানুষের মধ্যে কতোটা সহজে রোগটি ছড়িয়ে পড়তে পারে?
রোগটির প্রাদুর্ভাবের শুরুতে চীনের কর্তৃপক্ষ বলেছিল, ভাইরাসটি মানুষের মধ্যে ছড়াচ্ছে না- তবে বর্তমানে এই ধরণের রোগী পাওয়া গেছে। বিজ্ঞানীরা এখন বলছেন যে, একেকজন সংক্রমিত ব্যক্তি রোগটি গড়ে ১.৪ থেকে ২.৫ জন ব্যক্তির মধ্যে ছড়িয়ে দিচ্ছে।
এই সংখ্যাকে বলা হয়ে থাকে ‘বেসিক রিপ্রোডাকশন নাম্বার অথবা মৌলিক প্রজনন সংখ্যা’- যা একের বেশি হওয়ার অর্থই হলো রোগটি স্বনির্ভর হয়ে উঠেছে।
সুতরাং আমরা এতোদিনে জেনে গেছি যে, এটি এমন একটি ভাইরাস যা নিজে থেকে বিনষ্ট কিংবা বিলুপ্ত হয়ে যাবে না।
শুধুমাত্র চীনে গৃহীত সিদ্ধান্ত হলো- শহরগুলো বন্ধ করে দেওয়ার মতো কড়া পদক্ষেপের কারণেই শুধুমাত্র রোগটির বিস্তার ঠেকানো যেতে পারে।
যদিও এসব সংখ্যা এখনও প্রাথমিক একটি হিসাব, তারপরেও তারা করোনা ভাইরাসকে সার্স ভাইরাসের সঙ্গে তুলনা করছেন।
এখানে আরো উদ্বেগের বিষয় হলো, রোগে আক্রান্ত হওয়ার কোনো লক্ষণ ছাড়া ব্যক্তিরাও ভাইরাসটি ছড়িয়ে দিচ্ছেন।
তবে কতো তাড়াতাড়ি কিংবা কতো সহজে সেটি ঘটতে পারে, তা এখনও পরিষ্কার নয়, তবে এর ফলে ভাইরাসটি সংক্রমণ ঠেকানো আরও বেশ কঠিন হয়ে পড়বে।
ভাইরাসটি কতো দ্রুত ছড়াচ্ছে?
রোগীদের সংখ্যা বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে সপ্তাহে প্রায় ৪০ হতে ৮০০ জন আক্রান্ত হচ্ছে এই করোনা ভাইরাসে। তবে এই পরিসংখ্যানের মধ্যেও বিভ্রান্তি রয়েছে। বেশিরভাগ নতুন রোগী আগে থেকেই চীনে ছিলেন, শুধুমাত্র চীন তাদের নজরদারি বাড়ানোর পরই সনাক্ত হয়েছে। যে কারণে মহামারিটির বিস্তার সম্পর্কে খুবই কম তথ্যই পাওয়া যাচ্ছে।
তবে বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, যেসব তথ্য উপাত্তের কথা বলা হচ্ছে সম্ভবত এর চেয়ে বেশি মানুষ রোগটিতে আক্রান্ত হয়ে অসুস্থ হয়ে পড়ছে তাই।
চীনের বাইরেও যেভাবে রোগে আক্রান্তদের সংখ্যা বাড়ছে, তাতে করে ধারণা করা হচ্ছে যে, চীন সরকার আক্রান্তের যে সংখ্যা বলছে (প্রায় ৬০০০ রোগী), আসল রোগীদের সংখ্যা তারও দ্বিগুণ হতে পারে। তবে তার মানে এই নয় যে, মহামারিটি দ্বিগুণ আকৃতির ধারণ করেছে।
যদিও এখনো রোগটির প্রাদুর্ভাব উহান কেন্দ্রিক রয়েছে, তবে থাইল্যান্ড, জাপান, ফ্রান্স, দক্ষিণ কোরিয়া, ভিয়েতনাম, সিঙ্গাপুর, তাইওয়ান, নেপাল এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে করোনা ভাইরাস রোগী পাওয়া গেছে।
ভাইরাসটির কী আরও পরিবর্তন ঘটতে পারে?
হতেই পারে। সবসময়েই ভাইরাসের পরিবর্তন ও বিকালও ঘটতে পারে। এর এর অর্থই আসলে কি, সেটা বলা কঠিন সবার জন্যই।
করোনা ভাইরাস এক প্রজাতি হতে অন্য প্রজাতিতে ছড়িয়ে পড়ছে। এটা হয়তো একজন ব্যক্তি থেকে আরেকজন ব্যক্তিতে ছড়ানোর জন্য পরিবর্তিত হতে পারে বা আরও মারাত্মক উপসর্গও দেখা দিতে পারে। সে জন্যই ঘনিষ্ঠভাবে নজরে রেখেছেন বিজ্ঞানীরা।
ভাইরাসটি কিভাবে ঠেকানো যাবে?
আমরা এখন জানি যে, ভাইরাসটি নিজে থেকে কোনো মতেই ধ্বংস হবে না। শুধুমাত্র চীনের কর্তৃপক্ষে নেওয়া পদক্ষেপই এই মহামারীর অবসান ঘটতে পারে। ভাইরাস প্রতিরোধ করতে কোনো ভ্যাকসিন বা টিকা এখনও আবিষ্কৃতই হয়নি।
এই রোগ থেকে রক্ষার একমাত্র উপায় হলো অন্যদের মধ্যে ভাইরাসের সংক্রমণ হতে না দেওয়া। অর্থাৎ সতর্কতামূলক কঠোর পদক্ষেপ গ্রহণ করা।
যার মানে হলো:
# মানুষজনের চলাচল সীমিত করে দেওয়া।
# হাত ধুতে সবাইকে সবাইকেই উৎসাহিত করা।
# স্বাস্থ্যকর্মীরা প্রতিরক্ষামূলক পোশাক পরে রোগীদের পৃথক পৃথক করে চিকিৎসা সেবা দেওয়া।
রোগীদের ভাইরাস রয়েছে কিনা তা জানতে ও রোগীদের সংস্পর্শে আসা লোকদের সনাক্ত করার জন্যও গোয়েন্দাগিরি কর্মকাণ্ড বা নজরদারি ব্যবস্থার প্রয়োজন রয়েছে।