দি ঢাকা টাইমস্ ডেস্ক ॥ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্কে জন্মগ্রহণ করা বরিস জনসন ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব গ্রহণ করতে চলেছেন। দেড় যুগের সাংবাদিকতা ও রাজনৈতিক জীবনে নানা উত্থান-পতনের পর এ পদে আসীন হতে চলেছেন তিনি।
গতকাল (মঙ্গলবার) ক্ষমতাসীন কনজারভেটিভ পার্টি তাদের নতুন প্রধান হিসেবে ৫৫ বছর বয়সী সাবেক এই পররাষ্ট্রমন্ত্রীর নাম ঘোষণা করা হয়।
ব্রেক্সিট নিয়ে বেহাল দশায় গত জুনে তেরেসা মে ক্ষমতাসীন টোরি দলের নেতৃত্ব এবং প্রধানমন্ত্রীত্ব ছেড়ে দেওয়ার পর কয়েক সপ্তাহের নেতৃত্ব নির্বাচন প্রক্রিয়া শেষে ‘কট্টর ব্রেক্সিটপন্থি’ জনসন প্রধানমন্ত্রীর পদে স্থলাভিষিক্ত হলেন।
বর্তমান পররাষ্ট্রমন্ত্রী জেরেমি হান্টের সঙ্গে চূড়ান্ত পর্যায়ে জনসনের প্রতিদ্বন্দ্বিতা ছিল। তবে দলের নিবন্ধিত কর্মী-সমর্থকরা শেষ পর্যন্ত লন্ডনের সাবেক এই মেয়রকেই বেছে নিলেন।
ইউরোপিয়ান পার্লামেন্টের সাবেক কনজারভেটিভ সংসদ সদস্য স্ট্যানলি জনসন এবং তার প্রথম স্ত্রী চিত্রকর শার্লট ফসেটের সন্তান আলেক্সান্ডার বরিস দে পিফেল জনসন ১৯৬৪ সালের জুন মাসে যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্কে জন্মগ্রহণ করেন।
চার ভাইবোনের মধ্যে সকলের বড় জনসনের শৈশব কেটেছে নিউইয়র্ক, লন্ডন ও ব্রাসেলসে। তিনি বধির ছিলেন। যে কারণে শৈশবেই তাকে বেশ কয়েকবার অপারেশনের টেবিলে যেতে হয়। জনসন সেই সময় তুলনামূলক চুপচাপ ছিলেন বলে তার আত্মীয়স্বজনরা জানিয়েছে।
কিং স্কলারশিপে বার্কশায়ারের ইটন কলেজে পড়ার পর জনসন অক্সফোর্ডের বেলিওল কলেজে ক্ল্যাসিকসে ডিগ্রি নেন। তিনি বিতর্ক সংগঠন অক্সফোর্ড ইউনিয়নের প্রেসিডেন্ট ছিলেন। তিনি ছিলেন বুলিনডং ক্লাবের সদস্য, যেখানে তার সঙ্গী ছিলেন ডেভিড ক্যামেরন।
দুই ছেলে এবং দুই মেয়ের বাবা জনসন ১৯৮৭ সালে অ্যালেগ্রা মস্টিন ওয়েনকে বিয়ে করলেও তাদের ঘর সংসার বেশিদিন স্থায়ী হয়নি। ১৯৯৩ সালে জনসন আইনজীবী মেরিনা-হুইলারের সঙ্গে আবার গাঁটছড়া বাঁধেন। জনসনের ৪ সন্তানের মা-ই মেরিনা। দুই যুগ পর গত বছর তাদের বিচ্ছেদ ঘটে।
নানা প্রবন্ধ সংকলন ‘লেন্ড মি ইউর ইয়ারস’ ছাড়াও জনসন উপন্যাস ‘সেভেন্টি টু ভার্জিনস’ এবং রোমান সাম্রাজ্যের ইতিহাস নিয়ে ‘দ্য ড্রিম অব রোম’ উপন্যাস লিখেছেন। ২০১৪ সালে তার ঝুলিতে যুক্ত করেন সাবেক ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী উইনস্টন চার্চিলকে নিয়ে লেখা ‘দ্য চার্চিল ফ্যাক্টর: হাউ ওয়ান ম্যান মেইড হিস্টরি’ বইটি।
জনসনের সাংবাদিকতার জীবন
১৯৮৭ সালে টাইমসে প্রতিবেদক হিসেবে যোগ দেওয়ার পর একজনের উদ্ধৃতি জাল করায় চাকরি হারাতে হয় জনসনকে।
ডেইলি টেলিগ্রাফে জনসন ইউরোপবিষয়ক সংবাদদাতা হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন ৫ বছর। তারপরে ১৯৯৪ হতে ১৯৯৯ পর্যন্ত তিনি একই প্রতিষ্ঠানের সহকারী সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন।
১৯৯৪ সাল থেকেই জনসন ম্যাগাজিন ‘দ্য স্পেকটেটরে’ রাজনৈতিক কলাম লেখা শুরু করে দেন। ১৯৯৯ সালে তিনি ম্যাগাজিনটির সম্পাদক নিযুক্ত হন। তিনি এই দায়িত্ব পালন করেন ২০০৫ পর্যন্ত।
টেলিগ্রাফে থাকার সময় ১৯৯৭ সালে ক্লয়েড সাউথ এলাকা হতে কনজারভেটিভ প্রার্থী হিসেবে হাউস অব কমন্স নির্বাচনে অংশ নেন জনসন। সেই বছর লেবার পার্টির মার্টিন জোন্সের কাছে পরাজিত হন তিনি।
১৯৯৮ সাল হতে জনসনকে বিবিসির ‘হ্যাভ আই গট নিউজ ফর ইউ’সহ টেলিভিশনের বিভিন্ন অনুষ্ঠানেও জনসনকে দেখা যায়। বিব্রতভাব ও মাঝে মাঝেই উল্টোপাল্টা মন্তব্যের কারণে তিনি টক শো’র জনপ্রিয় এক মুখে পরিণত হন।
২০০১ সালের পার্লামেন্ট নির্বাচনে হেনলি অন টেমস আসনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার পর বিজয়ী হন এই কনজারভেটিভ সদস্য। টেলিভিশন এবং রাজনৈতিক অঙ্গনে সুপরিচিত হলেও জনসনের রাজনৈতিক উত্থান খুব একটা কুসুমাস্তীর্ণ ছিল না।
স্পেকটেটরের একটি সম্পাদকীয় প্রকাশের জেরে তাকে লিভারপুল শহরের কাছে ক্ষমাও চাইতে হয়। এক সাংবাদিকের সঙ্গে প্রেমের গুঞ্জনে ছায়া শিল্পমন্ত্রীর দায়িত্ব থেকেও তাকে সরিয়ে দেওয়া হয়েছিলো।তবে এর কোনোটাই ২০০৫ এর নির্বাচনে তার আবার জয়ী হওয়ার পথে বাধা হয়ে দাঁড়ায়নি।
দুই বছর লন্ডনের মেয়র নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার পর অপরাধ দূর ও যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়নের প্রতিশ্রুতি দিয়ে বাজিমাত করেন বরিস জনসন। সেবার লেবারের কেন লিভিংস্টোনকে খুব সামান্য ভোটের ব্যবধানে পরাজিত করে তিনি যুক্তরাজ্যের রাজধানীতে রক্ষণশীলদের অভাবিত জয় এনে দিয়েছিলেন।
২০১২ সালের নির্বাচনে আবার লিভিংস্টোনকে হারিয়ে দলকে দিয়েছিলেন স্বস্তি। আবার ২০১৫ সালে পশ্চিম লন্ডনের উক্সব্রিজ অ্যান্ড সাউথ রুইস্লিপ আসনে জয়ী হয়ে পার্লামেন্টে ঢোকেন জনসন।
তবে লন্ডনের পরের মেয়র নির্বাচনে দাঁড়াননি বরিস জনসন। তার বদলে থাকা কনজারভেটিভ পার্টির প্রার্থীকে হারিয়ে শহরটির মেয়র পদে নির্বাচিত হয়েছিলেন সাদিক খান।
মেয়রের দায়িত্ব ছাড়ার আগেই জনসন হয়ে ওঠেন যুক্তরাজ্যের ইউরোপীয় ইউনিয়ন ছাড়ার পক্ষে থাকা অন্যতম প্রভাবশালী একজন প্রচারক। ইউরোপকে এক করতে ইউরোপীয় ইউনিয়নের চেষ্টাকে নেপোলিওন ওয়ান এবং অ্যাডলফ হিটলারের চেষ্টার সঙ্গে তুলনা করে বেশ সমালোচিতও হন বরিস জনসন।
তেরেসা মে প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পর জনসনকে তার মন্ত্রিসভার পররাষ্ট্র দফতরের দায়িত্ব দেন। সর্বশেষ ২০১৭ সালের জুনে অনুষ্ঠিত আগাম নির্বাচনে সংখ্যাগরিষ্ঠতা হারানোর পর মের সংখ্যালঘু সরকারের মন্ত্রিসভাতেও জনসনের পদ বহাল থাকে।