দি ঢাকা টাইমস্ ডেস্ক ॥ প্রাণঘাতি করোনার উৎপাতে বিশ্ববাসী পর্যুদস্তু। তবে সব মানুষের জন্যই এই রোগটি খুব ভয়াবহ নয়, কিন্তু অনেকেই মারাও যায় এই রোগে। করোনা ভাইরাস কীভাবে শরীরকে ক্ষতিগ্রস্থ করে?
করোনা ভাইরাসটি কীভাবে দেহে আক্রমণ করে, কেনো করে, কেনোই বা কিছু মানুষ এই রোগে মারা যায়?
‘ইনকিউবেশন’ বা প্রাথমিক লালনকাল কেমন হয়
এই সময় ভাইরাসটি নিজেকে ধীরে ধীরে প্রতিষ্ঠিত করে। মানবদেহের শরীর গঠন করা কোষগুলোর ভেতরে প্রবেশ করে সেগুলোর নিয়ন্ত্রণ নিয়ে নেওয়ার মাধ্যমে কাজ করে এই ভাইরাসটি।
করোনা ভাইরাস, যার আনুষ্ঠানিক নাম সার্স-সিওভি-২, আপনার নি:শ্বাসের সাথে আপনার দেহে প্রবেশ করতে পারে (আশেপাশে কেও হাঁচি বা কাশি দিলে) বা ভাইরাস সংক্রমিত কোনো জায়গায় হাত দেওয়ার পর আপনার মুখে হাত দিলে।
শুরুতে এটি গলা, শ্বাসনালীগুলো এবং ফুসফুসের কোষে আঘাত করে ও সেসব জায়গায় করোনার কারখানা তৈরি করে। পরে শরীরের বিভিন্ন জায়গায় নতুন ভাইরাসটি ছড়িয়ে দেয় এবং আরও কোষকে আক্রান্ত করে।
এই শুরুর সময়টাতে আপনি অসুস্থ হবেন না এবং কিছু মানুষের মধ্যে হয়তো কোনো উপসর্গও দেখা দেবে না।
ইনকিউবেশনের সময়ের – প্রথম সংক্রমণ ও উপসর্গ দেখা দেওয়ার মধ্যবর্তী সময় – স্থায়িত্ব একেকজনের জন্য একেকরকম হয়, তবে গড়ে তা ৫ দিন।
এটি একটি নিরীহ অসুখ!
অধিকাংশ মানুষের অভিজ্ঞতায় দেখা যায় যে, করোনা ভাইরাস নিরীহ অসুখই মনে হবে। ১০ জনে ৮ জন মানুষের জন্যই কোভিড-১৯ একটি নিরীহ সংক্রমণ ও এর প্রধান উপসর্গ কাশি ও জ্বর। শরীরে ব্যাথা, গলা ব্যাথা ও মাথাব্যাথাও হতে পারে, তবে হবেই এমন কোনো কথাও নেই।শরীরের রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থা ভাইরাস সংক্রমণ হওয়ার কারণে প্রতিক্রিয়া প্রকাশ করার ফলেই গায়ে জ্বর আসে।
রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থা ভাইরাসটিকে মূলত শত্রুভাবাপন্ন একটি ভাইরাস হিসেবে শনাক্ত করে এবং এটি বাকি শরীরে সাইটোকাইনস নামক কেমিক্যাল পাঠিয়ে বুঝিয়ে দেয় কিছু একটা ঠিক নেই। যে কারণে শরীরে ব্যাথা ও জ্বরের মত উপসর্গ দেখা দেয়।
করোনা ভাইরাসের কারণে প্রাথমিকভাবে শুষ্ক কাশি হতে পারে। কোষগুলো ভাইরাসের মাধ্যমে সংক্রমিত হওয়ার কারণে অস্বস্তিতে পড়ার কারণে সম্ভবত শুকনো কাশিও হয়ে থাকে।
তবে অনেকেরই কাশির সঙ্গেই একটা পর্যায়ে থুতু বা কফ বের হওয়া শুরু করবে যার মধ্যে ভাইরাসের প্রভাবে মৃত ফুসফুসের কোষগুলো থাকবে।
এই ধরনের উপসর্গ দেখা দিলে পরিপূর্ণ বিশ্রাম, প্রচুর তরল পান করা ও প্যারাসিটামল খাওয়ার উপদেশ দেওয়া হয়ে থাকে। এ ধরনের উপসর্গ দেখা দিলে হাসপাতাল বা বিশেষজ্ঞের পরামর্শ নেওয়ার প্রয়োজন পড়ে না।
এই ধাপটি এক সপ্তাহের মতো স্থায়ি হয়। অধিকাংশ মানুষই এই ধাপের মধ্যেই আরোগ্য লাভ করে থাকে, কারণ ততোদিনে তাদের শরীরের রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থা ভাইরাসের সঙ্গে লড়াই করে সেটিকে প্রতিহত করে ফেলে। তবে কিছু কিছু মানুষের মধ্যে কোভিড-১৯ এর আরও ক্ষতিকর একটি সংষ্করণ তৈরি হয়ে থাকে।
এই রোগটি সম্পর্কে হওয়া নতুন গবেষণায় ধারণা প্রকাশ করা হয়েছে যে, রোগটির এই ধাপে আক্রান্তদের সর্দি লাগতে পারে।
করোনা ভয়াবহ ব্যধি
এই ধাপের পরও যদি রোগ অব্যাহত থাকে, তাহলে শরীরের রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থা ভাইরাসটি সম্পর্কে অতিরিক্ত প্রতিক্রিয়াশীল হওয়ায় স্বাভাবিক।
যে কেমিক্যালগুলো শরীরে বার্তা পাঠাতে থাকে, সেগুলোর প্রতিক্রিয়া তখন শরীরের বিভিন্ন জায়গায় প্রদাহ সৃষ্টি হয়।
লন্ডনের কিংস কলেজের ডক্টর নাথালি ম্যাকডরমেট এই বিষয়ে বলেন, “রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থায় ভারসাম্য নষ্ট করে দেয় এই ভাইরাসটি। যে কারণে শরীর অতিরিক্ত মাত্রায় ফুলে যাওয়া শুরু হয়। কীভাবে এটি ঘটছে, তা আমরা এখনও নিশ্চিতভাবে কিছুই জানি না।” ফুসফুসে প্রদাহ তৈরি হওয়াকেই নিউমোনিয়া বলে।
মুখ দিয়ে প্রবেশ করে শ্বাসনালী দিয়ে ফুসফুসের ছোট টিউবগুলোয় যদি যাওয়া যেতো, তাহলে হয়তো শেষপর্যন্ত ক্ষুদ্র আকারের বায়ুথলিতে গিয়ে পৌঁছানো যেতো।
এই থলিগুলোতেই রক্তে অক্সিজেন যায় ও কার্বন ডাই অক্সাইড বের হয়। তবে নিউমোনিয়ার ক্ষেত্রে এই ক্ষুদ্র থলিগুলো পানি দিয়ে ভর্তি হতে শুরু করে ও ফলস্বরূপ শ্বাস নিতে অস্বস্তি তৈরি করা, শ্বাসপ্রশ্বাসে সমস্যার মতো উপসর্গ তৈরি করে থাকে। তখন কিছু মানুষের শ্বাস নিতে ভেন্টিলেটরও প্রয়োজন হয়। চীন থেকে পাওয়া তথ্য উপাত্ত অনুযায়ী দেখা যায়, এই ধাপে ১৪% মানুষ আক্রান্ত হয়ে পড়ে।
অতি জটিল একটি রোগ
এখন পর্যন্ত ধারণা করা হচ্ছে যে, প্রায় ৬% করোনা আক্রান্ত ব্যক্তির রোগ অতি জটিল পর্যায়ে গিয়ে থাকে। এই ধাপে শরীর স্বাভাবিক কার্যক্রম চালাতে অসক্ষম হয় ও মৃত্যুর বড় ধরনের সম্ভাবনাও তৈরি হয়।
মূল সমস্যাটা হলো, এই ধাপে রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থা নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যেতে শুরু করে ও সারা শরীরেই বিভিন্ন রকম ক্ষয়ক্ষতি তৈরি করে থাকে।
রক্তচাপ যখন মারাত্মকভাবে নেমে যায় তখন এই ধাপে সেপটিক শকও পেতে পারেন আক্রান্ত ব্যক্তি, এমনকি রোগির অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ কাজ করা বন্ধ হওয়ারও সম্ভাবনা থাকে।
শ্বাস-প্রশ্বাসে তীব্র সমস্যা হওয়ার উপসর্গ দেখা দিয়ে থাকে ফুসফুসে প্রদাহ ছড়িয়ে পড়লে, কারণ সেই সময় শরীরকে টিকিয়ে রাখার জন্য যথেষ্ট অক্সিজেন পুরো শরীরে প্রবাহিত হতে পারে না। যে কারণে কিডনি রক্ত পরিশোধন ছেড়ে দিতে পারে ও অন্ত্রের দেওয়াল ক্ষতিগ্রস্থ হতে পারে।
চিকিৎসক ভারত পঙ্খানিয়া বলেন, “ভাইরাসটি এতো বড় পরিসরে প্রদাহ তৈরি করে যে, শরীর পুরো ভেঙ্গে পড়ে, একসঙ্গে একাধিক অঙ্গ প্রত্যঙ্গ ফেইল করতে পারে।”
এই পর্যায়ে শরীরের রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থা যদি ভাইরাসের সঙ্গে পেরে না ওঠে তাহলে তা শরীরের সব প্রান্তে ছড়িয়ে পড়ে ও আরও বড় ধরনের ক্ষতির সম্ভাবনা সৃষ্টি করে।
এই পর্যায়ে আক্রান্তকে চিকিৎসা দিতে ইসিএমও বা এক্সট্রা-কোর্পোরেয়াল মেমব্রেন অক্সিজেনেশন পদ্ধতি ব্যবহার করাও হতে পারে।
এই পদ্ধতিতে একটি কৃত্রিম ফুসফুস দ্বারা টিউবের মাধ্যমে শরীর হতে রক্ত বের করে নিয়ে সেই রক্ত অক্সিজেনপূর্ণ করে আবার শরীরে প্রবেশ করানো হয়ে থাকে। তবে কখনও কখনও ক্ষতির মাত্রা বেশি হলে অঙ্গ প্রত্যঙ্গ শরীরকে আর তখন বাঁচিয়ে রাখতে সক্ষম হয় না।
তথ্যসূত্র: বিবিসি বাংলা
করোনা ভাইরাস প্রতিরোধে করণীয়
# সব সময় ঘরে থাকি।
# জরুরি প্রয়োজনে বাইরে বের হলে নিয়মগুলো মানি, মাস্ক ব্যবহার করি।
# তিন লেয়ারের সার্জিক্যাল মাস্ক ইচ্ছে করলে ধুয়েও ব্যবহার করতে পারি।
# বাইরে থেকে ঘরে ফেরার পর পোশাক ধুয়ে ফেলি। কিংবা না ঝেড়ে ঝুলিয়ে রাখি অন্তত চার ঘণ্টা।
# বাইরে থেকে এসেই আগে ভালো করে (অন্তত ২০ সেকেণ্ড ধরে) হাত সাবান বা লিকুইড দিয়ে ধুয়ে ফেলি।
# প্লাস্টিকের তৈরি পিপিই বা চোখ মুখ, মাথা একবার ব্যবহারের পর অবশ্যই ডিটারজেন্ট দিয়ে ভালো করে ধুয়ে শুকিয়ে ব্যবহার করা যেতে পারে।
# কাপড়ের তৈরি পিপিই বা বর্ণিত নিয়মে পরিষ্কার করে পরি।
# চুল সম্পূর্ণ ঢাকে এমন মাথার ক্যাপ ব্যবহার করি।
# হাঁচি কাশি যাদের রয়েছে সরকার হতে প্রচারিত সব নিয়ম মেনে চলি। এছাড়াও খাওয়ার জিনিস, তালা চাবি, সুইচ ধরা, মাউস, রিমোট কন্ট্রোল, মোবাই, ঘড়ি, কম্পিউটার ডেক্স, টিভি ইত্যাদি ধরা ও বাথরুম ব্যবহারের আগে ও পরে নির্দেশিত মতে হাত ধুয়ে নিন। যাদের হাত শুকনো থাকে তারা হাত ধোয়ার পর Moisture ব্যবহার করি। সাবান বা হ্যান্ড লিকুইড ব্যবহার করা যেতে পারে। কেনোনা শুকনো হাতের Crackle (ফাটা অংশ) এর ফাঁকে এই ভাইরাসটি থেকে যেতে পারে। অতি ক্ষারযুক্ত সাবান বা ডিটারজেন্ট ব্যবহার থেকে বিরত থাকাই ভালো।