দি ঢাকা টাইমস ডেস্ক ॥ প্রতি সপ্তাহের মতো আজও আমরা বিশ্বের বিভিন্ন মজার মজার খবর আপনাদের সামনে তুলে ধরবো- আশা করি আপনাদের ভালো লাগবে।
পৃথিবীর গায়ে জ্বর
সুস্থ শরীরের তাপমাত্রা দেড় থেকে দুই ডিগ্রি ফারেনহাইট বাড়লেই জ্বর। জ্বরের মোক্ষম দাওয়াই প্যারাসিটামল। পৃথিবীর জ্বর হলে? হিসেব বলছে, গত ১০০ বছরে পৃথিবীর গড় তাপমাত্রা বেড়েছে এক থেকে দেড় ডিগ্রি ফারেনহাইট এবং আগামী ১০০ বছরে তা বেড়ে যেতে পারে আরও ১১.৫ ডিগ্রি পর্যন্ত। পৃথিবীর এই প্রবল জ্বরে হিমালয়, আন্দিজ, সুমেরু, কুমেরুর বরফ গলবে। হিমবাহ থেকে তৈরি নদীগুলো প্রথমে হূষ্টপুষ্ট হলেও পরে যাবে শুকিয়েঃ বরফ গলে জল তখন শেষ। পরিণতি- সমুদ্রে জলোচ্ছ্বাস। বাড়তি জলে গভীরতা বাড়বে। কতখানি? আগামী ১০০ বছরে আড়াই ফুট পর্যন্ত। তাতে ডুবে যাবে সুন্দরবনসহ বাংলাদেশের বেশির ভাগ অংশ আর পৃথিবীর সমুদ্র উপকূলের বহু সুন্দর শহর-নগর-গ্রাম। আন্দামান, মালদ্বীপ, জাভা, সুমাত্রা, বালিঃ।
আবার নদী শুকিয়ে যাওয়ায় আশপাশের কৃষিখেতে জলের জোগান কমবে। আমাজন, নিল, পদ্মা, ভলগার দুই ধারে যত্নে লালিত শিল্প লাটে উঠবে। মানুষ জলের আশায় জীবন বাঁচাতে উদ্বাস্তু হয়ে অন্যত্র ছুটবে।
পৃথিবীর প্রতিকূল উষ্ণতায় জীবাণু, ছত্রাক, গাছপালা, কীটপতঙ্গ, পশুপাখি হাঁসফাঁসিয়ে উঠবে। অসহ্য হয়ে কত বিচিত্র প্রাণ পৃথিবী থেকে চিরতরে বিদায় নেবে। সিঙ্কোনা গাছ উধাও হলে ম্যালেরিয়ার ওষুধ আর মিলবে না। নয়নতারা না থাকলে যেখান-সেখান থেকে ক্যান্সারের ওষুধও আর পাওয়া যাবে না। ডোডো পাখি, গোলাপি হাঁস, জাগুয়ারের মতো এভাবেই কি ক্রমশ হারিয়ে যাবে জীববৈচিত্র্য? গরম বাড়লে বাড়বে নানা কীটপতঙ্গসহ মশার প্রকোপ।
৪০ বছর ধরেই এগিয়ে চলছে নানা গবেষণা। তবে ইউএনওর ‘ইন্টারগভর্নমেন্টাল প্যানেল অন ক্লাইমেট চেঞ্জ’ সংস্থাটি এ গ্রহেরই ১৩০টি দেশের আড়াই হাজার বিজ্ঞানী নিয়ে যে সিদ্ধান্তে পৌঁছলেন, সেটাই সম্ভবত পৃথিবীর জ্বরের সম্ভাব্য কারণ- ‘গ্রিনহাউস এফেক্ট।’ শীতের দেশে গাছপালাকে বাঁচিয়ে রাখার জন্য কাচের ঘর বানানো হয়। তাতে জীবন্ত সবুজ। তাই এরকম নাম।
দিনে সূর্যের আলো কাচ ভেদ করে গ্রিনহাউসের মাটিকেও গরম করে। আলোকশক্তি বদলে যায় তাপশক্তিতে। তাতেই গ্রিনহাউস গরম। একেই বলে ‘গ্রিনহাউস এফেক্ট’।
মাথার উপরে কাচের ঢাকনা না থাকলেও পৃথিবীটা কিন্তু একরকম গ্রিনহাউসই। বিশেষ কিছু গ্যাস, জলীয় বাষ্প, কার্বন ডাই-অক্সাইড, মিথেন, ক্লোরোফ্লুরোকার্বন, নাইট্রাস অক্সাইড ওই কাচের আস্তরণের কাজ করে চলেছে। কিন্তু দিনে সূর্য থেকে পাওয়া সব তাপই যদি রাতে পৃথিবী মহাশূন্যে ছেড়ে দিত, তবে পৃথিবী হিমশীতল হয়ে যেত। চাষাবাদ হতো না। গ্রিনহাউস এফেক্ট তাই দরকারি। পৃথিবীতে শক্তি উৎপাদনের মূল উৎসই হল তেল, কয়লা, গ্যাস, কাঠ। এগুলো পুড়িয়েই মেলে উপকারী শক্তি। সঙ্গে অপকারী কার্বন-ডাই-অক্সাইড। তাই চাই গ্রিন এনার্জির সৌরশক্তি, জলবিদ্যুৎ, উইন্ডমিল, পরমাণুশক্তির ব্যাপক ব্যবহার।
পেট্রোল ডিজেলের বদলে অভিনব কমপ্রেসড ন্যাচারাল গ্যাস ব্যবহারে গাড়ি একই দূরত্ব যেতে পারে, তুলনায় অনেক কম কার্বন-ডাই-অক্সাইড নিঃসরণ করে। পৃথিবীজুড়ে এখন স্লোগান- পানি, বিদ্যুৎ, তেল, কাগজ, জ্বালানির অযথা ব্যবহার কমাতে হবে। গাছ লাগালে তা বড় হয়ে বাতাসের কার্বন-ডাই-অক্সাইডকে শোষণ করবে। জনসংখ্যা বাড়লে অতিরিক্ত শক্তির প্রয়োজন মেটাতে পৃথিবী হিমশিম খাবে। এ কথাগুলোই গত এক দশকেরও বেশি সময় ধরে পৃথিবীর মানুষকে বলে চলেছেন অল গোর। মহাসাগর জুড়ে কেন ক্রমাগত বেড়ে চলেছে কাটরিনার মতো সাইক্লোনের তাণ্ডব? কী হবে যেদিন কুমেরু, সুমেরুর বরফজলে ভেসে যাবে পৃথিবীর প্রান্তর? পৃথিবীর এই চরমতম বিপদ ‘গ্লোবাল ওয়ার্মিং’-এর কারণ আর এই বিপদ থেকে উদ্ধারের পথ বাতলে দেওয়ার জন্যই ২০০৭ সালে নোবেল শান্তি পুরস্কারে সম্মানিত ইন্টারগভর্নমেন্টাল প্যানেল অন ক্লাইমেট চেঞ্জ সংস্থা আর অল গোর। ভিনগ্রহে প্রাণের সন্ধানে অনেক মহাকাশযান মহাকাশে পাঠিয়েছে মানুষ। আমাদের আশা, একদিন হয়তো সেই মহাকাশযানে ধরা পড়বে বহু দূর থেকে আসা কোন বন্ধুত্বের আবেদনি স্পন্দন। সেই স্পন্দনকে বুঝতে মানুষের হূদয় যেন সেদিনও স্পন্দিত হয়, আজকের মতোই।
রাজ্য হারানো এক রাজা
প্রতিদিনের জীবন-যন্ত্রণা থেকে দূরে কোন গ্রীষ্মমণ্ডলীয় দ্বীপে বাস করার স্বপ্ন অনেকেরই। কিন্তু এ স্বপ্ন বাস্তবে ধরা দিয়েছিল গ্রেট ব্রিটেনের এক বণিক পরিবারের কাছে। তারা এ দ্বীপমণ্ডলীর স্বত্ব পেয়েছিল ১৫০ বছরের জন্য। আকাশ থেকে এ দ্বীপগুলো দেখলে মনে হয় মুক্তার একটা মালা বিশাল এক বর্ণালী পাথরকে ঘিরে রেখেছে। ২৬টি ছোট ছোট দ্বীপের মধ্যে রয়েছে নীলচে সবুজ রঙের হ্রদ। দ্বীপের তালগাছগুলোর পাতা ঝিরিঝিরি শব্দে কাঁপে বাতাসে। পাথুরে তীরে সমুদ্রের ফেনায়িত ঢেউ আছড়ে পড়ার শব্দ শোনা যায় দূর থেকে। স্থানীয় লোকজনের বেশির ভাগেরই খালি পা। কেউ কেউ পরে থাকে ডুবুরি-জুতা। ভারত মহাসাগরে ভাসন্ত এই কোকোস কেলিং দ্বীপের অবস্থান অস্ট্রেলিয়া ও শ্রীলংকার মাঝামাঝি। ৫০০ লোকের বসবাস এখানে। তাদের অংশটি অস্ট্রেলিয়া শাসিত এলাকা হলেও মহাদেশীয় অনেক মানচিত্রেই এ দ্বীপের কোন উল্লেখ নেই। অথচ এই দ্বীপের রয়েছে এক অবাক করা ইতিহাস। ১৮২০ সাল পর্যন্ত এ দ্বীপগুলোতে কোন বসতি ছিল না। স্কটল্যান্ডের অভিযাত্রী জন ক্লুনিস-রস প্রথম ছোট আকারে বসবাস শুরু করেন। তিনি মূলত এসেছিলেন শেল্যান্ড থেকে। বরফাচ্ছন্ন নিজ দেশ থেকে এসে এমন স্বাস্থ্যকর, সূর্যকরোজ্জ্বল দ্বীপ পেয়ে তিনি উৎফুল্লই হয়েছিলেন। তিনি এখানে শত শত নারকেল গাছ লাগান। আর এ কাজে নিয়ে আসেন মালয়ী শ্রমিক। ক্লুনিস-রসের বংশধররা এখানে নারকেলভিত্তিক বাণিজ্য সাম্রাজ্য গড়ে তোলেন। নারকেলের শাঁস, শুকনো আঁশ ও নারকেল তেলের কাঁচামাল বিক্রিই ছিল তাদের মূল ব্যবসা। তাদের এ দ্বীপের ভোগদখল পাকাপোক্ত হয় ১৮৮৬ সালে। রানী ভিক্টোরিয়ার কাছ থেকে তারা এ দ্বীপের চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত লাভ করেন। সেই থেকে তারা কোকো দ্বীপের রাজা। কিন্তু তাদের এ রাজত্ব চলে ১৯৭৮ সাল পর্যন্ত। শেষ রাজা জন ক্লুনিস-রস অস্ট্রেলিয়ার চাপের মুখে এ দ্বীপ আড়াই মিলিয়ন পাউন্ডে বিক্রি করে দেন। তিনি অস্ট্রেলিয়া সরকার ও বিভিন্ন বাণিজ্য সংস্থার চাপে পড়েছিলেন। সামন্ততান্ত্রিক শাসনের কারণে জাতিসংঘও তার প্রতি বিরূপ ছিল। ক্লুনিস-রসের পরিবার বসবাস করত জমিদার বাড়িতে, যা এখনও সেই দ্বীপে দাঁড়িয়ে আছে। এ দ্বীপে রয়েছে ৩৫০ মালয়ী। তারা নরিকেল গাছ লাগাতে আসা শ্রমিকদের বংশধর। মেয়েরা মাথায় স্কার্ফ পরে। রাস্তার নাম মালয়ী ভাষায় লেখা। কয়েকটি মসজিদ আছে। ঘরবাড়িগুলো বেমানান মনে হলেও তা দেখতে স্কটল্যান্ডের পল্লী এলাকার বাড়ির মতো। একটি পাথুরে ক্রুশে ক্লুনিস-রসের পূর্বপুরুষদের নাম উৎকীর্ণ করা আছে। জন ক্লুনিস-রস লম্বা পদক্ষেপে তার প্রবাল সাম্রাজ্যে হাঁটাচলা করতেন। একটা ছোরা ঝোলানো থাকত তার কোমরের বেল্টে। মালয়ী শ্রমিকদের তিনি মজুরি দিতেন কোকোর নিজস্ব মুদ্রায়। এ মুদ্রা তিনি প্রচলন করেছিলেন। এগুলো শুধু তার কোম্পানির স্টোরেই চলত। শ্রমিকদের কেউ দ্বীপ ছেড়ে যেতে চাইলে তাদের বলা হতো- তারা এখান থেকে কখনও ফিরতে পারবে না। এ ধরনের শৃংখলা ও নিয়ম থাকলেও মালয়ীরা বর্তমানে দ্বিধাবিভক্ত। একদল মনে করেন, ক্লুনিস-রস ছিলেন বহিরাগত শোষক। অন্যদল মনে করে, তিনি ছিলেন দয়ালু বাবার প্রতীক। মজুরি কম থাকলেও পানি, বিদ্যুৎ ও স্কুলে লেখাপড়ার কোন খরচ দিতে হতো না। তারা আরও মনে করেন, আর কিছু না হোক বর্তমানে ভালো বাড়িঘর ও খাবার তো জুটছে।
চাপে পড়ে এ দ্বীপ বিক্রির আগে একটি শিপিং লাইন চালাতে ব্যর্থ হয়ে জন ক্লুনিস-রস দেউলিয়া হয়েছিলেন ব্যাংকের কাছে। শেষ বয়সে তার বাসস্থান ছিল পশ্চিম অস্ট্রেলিয়ায় পার্থের অখ্যাত এক শহরতলীতে। তবে তার ছেলে জনি ক্লুনিস-রস এখনও থাকছেন সে দ্বীপে। জাঁকজমকের সঙ্গে বেড়ে ওঠা জনি বর্তমানে থাকেন একটি বাংলোতে। তার বাবার সাদা শার্ট ও পায়জামার পরিবর্তে তিনি পরেন ধূসর টি-শার্ট এবং শর্টস। তার পরিবারের শাসন শেষ না হলে তিনি হতেন কোকো দ্বীপের ষষ্ঠ রাজা। তিনি বর্তমানে হতাশ হলেও ধৈর্যের সঙ্গে এগিয়ে যাচ্ছেন সামনে। বাপ-দাদার নরিকেলের ব্যবসা ভাগ্য ফিরিয়ে দিলেও তিনি এখন বিভিন্ন দ্বীপ থেকে ঝিনুক ও বড় শামুক সংগ্রহ করেন। একটা পুকুরে এগুলোর প্রজনন ঘটান। বিক্রি করেন ইউরোপ-আমেরিকার অ্যাকুরিয়াম ব্যবসায়ীদের কাছে। ভিন্ন ধারার এ কাজটিই করতে হচ্ছে জনিকে। অথচ এ দ্বীপে বসতি গড়েছিলেন তার পূর্বপুরুষ। এখন জনি যেন এক সাধারণ মানুষ। কিন্তু অসাধারণ তার অতীত।