দি ঢাকা টাইমস্ ডেস্ক ॥ সত্যিই এক বিচিত্র এই বিশ্ব জগত। ধর্ম-বর্ণ কোনো কিছুই যখন মানুষের প্রেমবোধের উপরে যায় না, তখন ঘটে যায় অনেক কিছু। এমনই এক ঘটনার সূত্রপাত ঘটেছে। এক ব্রিটিশ যুবক এসেছেন বাবার খোঁজে ঢাকায়!
জেমি হেনশ্যাল নামে এক ব্রিটিশ নাগরিক এসেছেন পুরান ঢাকায়, তবে বেড়াতে নয়, বাবার খোঁজে । ১৪ জানুয়ারি শাঁখারীবাজার হতে ছবিটি তুলেছেন সাইফুল ইসলাম। (মূল ছবির পাশে আপনারা যে ছবিটি দেখছেন সেটি সোয়াব আলী ও ক্লারা হেনশ্যাল, ১৯৭৯ সালে বিয়ের পর তোলা ছবি)।
সংবাদ মাধ্যমের খবরে জানা যায়, টানা ১০ দিন ধরে পুরান ঢাকার অলিগলি ও ভাঙা রাস্তায় ছুটে বেড়াচ্ছেন এই বাংলাদেশী বংশোদ্ভূত একজন ব্রিটিশ নাগরিক জেমি হেনশ্যাল। সোয়াব আলী নামে এক লোককে খুঁজে চলেছেন তিনি। এই সোয়াব আলীই তার হারিয়ে যাওয়া বাবা, তাকেই তিনি খুঁজছেন হন্যে হয়ে।
মা ক্লারা হেনশ্যালের কাছে জেমি জেনেছেন, বাবার আদি নিবাস হলো বাংলাদেশের পুরান ঢাকায়। ৩১ বছর পূর্বে যুক্তরাজ্য ছেড়ে ঢাকায় চলে আসেন তার বাবা সোয়াব আলী। আর ফিরে যাননি কোনোদিন। জেমি তখন কোলের শিশু ছিলেন।
তবে তার বাবা সোয়াব আলী সম্পর্কে এর বেশি কিছু জানেন না জেমি। জানেন না তার সঠিক কোনো ঠিকানাও। শুধু নাম ও বাবার দুটি পুরোনো ছবি সম্বল করে পুরান ঢাকার অলিগলি ঘুরে বেড়াচ্ছেন ৩৪ বছরের যুবক জেমি। জেমির বর্তমান নিবাস অস্ট্রেলিয়ার সিডনি শহর। সেখানেই তিনি আলোকচিত্রী, রন্ধনশিল্পী এবং টেলিভিশনে রান্নাবিষয়ক অনুষ্ঠানের নামকরা উপস্থাপকও। দ্য নর্দার্ন মাংকি ডট টিভি নামে তার একটি নিজস্ব অনলাইন টেলিভিশন রয়েছে। জেমির মা ক্লারা বসবাস করেন যুক্তরাজ্যের ম্যানচেস্টারে।
গত ১১ জানুয়ারি রাজধানীর একটি রেস্টুরেন্টে সংবাদ মাধ্যমের সঙ্গে কথা হয় জেমি হেনশ্যালের সঙ্গে। চোখের কালো মণি তার শরীরে বাঙালি রক্তের আভাস দিচ্ছে। তিনি জানিয়েছেন, পিতার খোঁজে এক অনিশ্চিত অভিযাত্রায় নেমেছেন।
এতোদিন পর কেনো জানতে চাইলে জেমির কালো চোখের টলটলে পানি সত্যিই এবার উপচে পড়লো। চোখ মুছে বলতে শুরু করলেন, ‘গত বছর আমি বিয়ে করেছি, আমার স্ত্রী লরা হাক্সলে সন্তানসম্ভবা। মাসখানেক আগে আমার স্ত্রী বললো, “তোমার সন্তানের পিতা তো তুমি, তবে তোমার পিতা কে? এই কথা যদি তোমার সন্তান কোনোদিন জানতে চায়, তার জবাব কী তোমার কাছে আছে?”’ স্ত্রীর এই প্রশ্নই জেমিকে গভীরভাবে নাড়া দেয়।
আর তাই বাবাকে খুঁজতে ৬ জানুয়ারি ঢাকায় আসেন জেমি। না পেয়ে গত ১৬ জানুয়ারি মন খারাপ করে নিজের কর্মস্থল অস্ট্রেলিয়ার সিডনিতে ফিরে যান। মায়ের কাছ হতে জেমি জেনেছেন, তাঁর দাদা উমাদ আলী পুরান ঢাকার কোনো একটি চামড়ার কারখানায় (ট্যানারিতে) কাজ করতেন। জেমি বাংলাদেশ ট্যানারি ওনার্স অ্যাসোসিয়েশনেও গেছেন। সংগঠনটি হতে তাকে আশ্বাস দেওয়া হয়, তারা চেষ্টা করছে এই নামে কেও ছিলেন কি না বা আছেন কি না, তা খুঁজে বের করতে।
বাবাকে খুঁজে পেতে যাতে সুবিধা হয় সেজন্য জেমি উঠেছিলেন পুরান ঢাকার সদরঘাটের আহসান মঞ্জিল এলাকার একটি ভাড়া বাড়িতে। পুরান ঢাকার বেশির ভাগ থানায় গিয়ে খোঁজ নিয়েছেন এই নামে কারও কোনো রেকর্ড রয়েছে কি না। জাতীয় পরিচয়পত্র, নিবন্ধন উইং হতে শুরু করে বাবার সম্ভাব্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান সেন্ট গ্রেগরি হাইস্কুল অ্যান্ড কলেজে গিয়েও খুঁজে করেছেন, সত্তরের দশকে এই নামে এখানে কোনো শিক্ষার্থী ছিলো কি না।
মায়ের কাছে জেমি জেনেছেন তার বাবা সোয়াব আলী ১৯৭৪ সালে যুক্তরাজ্যে পড়াশোনার উদ্দেশে গিয়ে রন্ধনশিল্পকে পেশা হিসেবে বেছে নেন। ১৯৭৬ সালে তার সঙ্গে পরিচয় হয় তরুণী হেনশ্যালের, তারপর প্রেম। ১৯৭৯ সালে তারা বিয়ে বন্ধনে আবদ্ধ হন। ১৯৮২ সালে জন্ম হয় জেমির। বাবা তার নাম দিয়েছিলেন মোহাম্মদ হোসেন আলী। তবে তার বংশপদবি দেওয়া হয় হেনশ্যাল। ১৯৮৬ সালে বাংলাদেশে একটি কাজে যাচ্ছেন বলে যুক্তরাজ্য ছাড়েন তার বাবা। তারপর আরে ফেরেননি তিনি।
জেমি বলেন, ‘জীবনে অনেক কিছুই পাওয়ার মাঝেও বড় একটি বেদনা হলো বাবাকে না পাওয়া। ৩ বছর বয়সে বাবাকে কেমন দেখেছিলাম, তা-ও এখন মনে নেই। এখন আমি নিজে বাবা হতে চলেছি। তাই আমি আমার নিজের বাবা কী জিনিস, তা বুঝতে পারছি।’
১৬ জানুয়ারি দেশে ফিরে যাওয়ার পূর্বে এই প্রতিনিধির সঙ্গে আবারও দেখা হয় জেমির। পরিশ্রান্ত-ক্লান্ত দেখাচ্ছিল জেমিকে। তবু মুখে হাসি ফুটিয়ে বললেন, ‘বাবাকে পাওয়ার কিছু সূত্র পেয়েছি। জুনে আবার আসবো। বাবা যদি বেঁচে থাকেন, তাহলে যেভাবেই হোক খুঁজে বের করবো তাকে।’ সত্যিই কী খুঁজে পাবেন জেমি তার বাবাকে? আমাদের প্রত্যাশা রইলো জেমি তার বাবাকে বা তার পরিবারের অন্য সদস্যদের যেনো খুঁজে পান, খুঁজে পান তার জন্মদাতাকে।